বন্যার পানি নামার পরে হাসপাতালে বাড়ছে সাপে কাটা রোগী
২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:৪১
ফেনী থেকে ফিরে: বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে বাড়তে শুরু করেছে সাপে কাটা রোগী। শুধুমাত্র শহর এলাকা থেকেই নয়, ফেনীর বিভিন্ন উপজেলা থেকেও রোগীরা আসছে জেলার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। একইসঙ্গে বিভিন্ন উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সেও সাপে কাটা রোগীরা চিকিৎসা নিয়ে ভর্তি হচ্ছে।
গতকাল রোববার (১ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত মোট ৯৮ জন সাপে কাটা রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
ফেনী জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে হাসপাতালে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই আসছেন চিকিৎসা নিতে। এর মাঝে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা বেশি। এর পাশাপাশি সাপে কাটা অনেকেই চিকিৎসা নিতে আসছেন। অনেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। কারণ সাপে কাটা সবার অবস্থা কিন্তু গুরুতর হয় না। তবে যাদের অবস্থা গুরুতর তাদের হাসপাতালে ভর্তি রাখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বন্যা পরবর্তী সময়ে নানা পানিবাহিত রোগ মোকাবিলার পাশাপাশি সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে আছে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২১ আগস্ট থেকে ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের নিচতলা বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় রোগীদের সাময়িকভাবে দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় স্থানীয় কয়েকটি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হয়। ২৭ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালটির নিচতলার প্রতিটি কক্ষ ডুবে ছিল। ডায়রিয়া ওয়ার্ডটিও পানিতে ডুবে গিয়েছিল। পরবর্তীতে পানি নামার পর পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি রোগীর সেবাও চলছে। এখন পরিষ্কার করে ওখানেই রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।
ধীরে ধীরে বন্যার পানি নেমে এলে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করে রোগী ভর্তি শুরু করা হয় বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলেও জানান তারা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জেলা শহরের হাসপাতালটি মোট ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হলেও রোববার (১ সেপ্টেম্বর) দিনও ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আসিফ ইকবাল বলেন, ‘বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। হাসপাতালে বিভিন্ন ধরণের রোগীরা আসছে চিকিৎসা নিতে। সাপে কাটা সবাইকে কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হয় না। আর তাই অনেকে প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ শেষেই বাড়ি ফিরে যান। গত ২৪ ঘণ্টায় সাপে কাটা যেসব রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসেছেন তার মাঝে ১৬ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।’
জরুরি ও বহির্বিভাগে বেড়েছে রোগীর চাপ
আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আসিফ ইকবাল বলেন, ‘শনিবার (৩১ আগস্ট) থেকে রোববার (১ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা সময়ে ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৩৭৪ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর পাশাপাশি ৭২০ জন রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন।’
এর আগে, ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে শুক্রবার (৩০ আগস্ট) থেকে শনিবার (৩১ আগস্ট) পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৬৭ জন। এছাড়া বহির্বিভাগে ৮০ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।
এছাড়া বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) থেকে শুক্রবার (৩০ আগস্ট) পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালটির বহির্বিভাগে ৪২০ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়াও এই ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৬৩ জন।
শুধুমাত্র ফেনী সদর উপজেলা নয়, জেলা শহরটির অন্যান্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এর মাঝে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেশি।
প্রসঙ্গত, ফেনী জেলার আওতায় থাকা ৬টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোও পানিবন্দী ছিল। তবে পানি নেমে যাওয়ার পরে বর্তমানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে বলে দাবি করেছেন সিভিল সার্জন মো. শিহাব উদ্দিনের।
ফেনীর বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালসহ মোট পাঁচটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে রোববার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা পর্যন্ত ৪৫৮ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন ভর্তি হয়ে। এর মাঝে ২৪ জন সাপে কাটা রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন বর্তমানে।
সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪ জন, ফুলগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক জন, ছাগলনাইয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক জন ও দাগনভুইয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুই জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী রোববার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন।
কর্তৃপক্ষ কী বলছেন?
ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল খায়ের মিয়াজি বন্যা পরবর্তী সময়ে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন ডা. মোবারক হোসেন দুলাল।
তবে আবুল খায়ের মিয়াজি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি প্রতিনিয়ত খবর রাখছি প্রতিষ্ঠানের। বন্যার শুরু থেকেই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। এখন বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। সাপে কাটা রোগীদের সবাইকে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হয় না। এর মাঝে অনেকেই প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ফিরে যান বাড়িতে। যারা গুরুতর হন তাদের আমরা ভর্তি করে চিকিৎসা দেই। এখন পর্যন্ত আমাদের পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম আছে। ফলে কেউ চিকিৎসাবঞ্চিত হবে না।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী বেশি আসছে চিকিৎসা নিতে। বিশেষ করে শিশুদের মাঝে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের আপাতত স্যালাইন বা অন্যান্য ওষুধ পত্রের তেমন সঙ্কট নেই। তবে আমরা দ্রুতই রিকুইজিশন দিয়ে নতুনভাবে ওষুধ নিয়ে আসবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়াতে আমরা নতুন ভবনের একটি ফ্লোরেও ডায়রিয়া রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছি। এছাড়াও চর্মজনিত নানা রকমের রোগ নিয়ে রোগীরা আসছেন। আমরা তাদেরও সেবা দিয়ে যাচ্ছি। হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগেও রোগীর চাপ সামাল দিয়ে সেবা দিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’
জেলা সিভিল সার্জন মো. শিহাব উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্যার পানি কমে যাওয়ার পরে বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে রোগীর চাপ বেড়েছে। সাপে কাটা রোগীরাও আসছেন। তবে আমরা যথাযথভাবে সবাইকে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে একদিকে পানিবাহিত নানা রোগ আর অন্যদিকে নানা রকমের চর্মরোগ নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে আসছেন। তবে আমরা পরিস্থিতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামাল দিয়ে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি।‘
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে নানা ধরণের রোগ নিয়ে হাসপাতালে রোগীরা আসছেন। আমরাও আমাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে তাদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বন্যার কারণে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কী কী ক্ষতি হয়েছে এর একটা তালিকা করে পাঠাতে বলেছি সিভিল সার্জনদের। আশা করছি সেটা হাতে পেলে আমরা আরও বিশদ ধারণা পাবো পরিস্থিতি সম্পর্কে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আছে আমাদের সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে। অ্যান্টিভেনমও পর্যাপ্ত মজুদ আছে। সুতরাং হাসপাতালে গেলেই সবাই চিকিৎসা পাবে।’
সারাবাংলা/এসবি/এমও