বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু, সতর্ক না হলে পরিস্থিতি হতে পারে ভয়াবহ
২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:৪৬
ঢাকা: চলতি বছরের জুনে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৭৯৮ জন চিকিৎসা নেন। এর মাঝে আটজন মারা যান। তবে জুলাই মাসে জুনের তুলনায় ৩ দশমিক ৩৪ গুণ বেশি বা দুই হাজার ৬৬৯ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এদের মধ্যে মারা যান ১২ জন। কিন্তু সেই হিসাব ছাড়িয়ে যায় আগস্টের পরিসংখ্যানে। এই মাসটিতে জুলাইয়ের তুলনায় ২ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি বা ছয় হাজার ৫২১ জন রোগী শনাক্ত হয়। যার মধ্যে মারা গেছেন ২৭ জন।
দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের যে পরিসংখ্যান তাতে দেখা যায়, আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসেই এর মাত্রা বাড়তে থাকে। তবে ২০২৩ সালে অক্টোবর পরবর্তী সময়েও আতঙ্ক ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। এদিকে চলতি মৌসুমের জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে জুনে। পরবর্তীতে জুলাই মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যানকে ভয়ঙ্কর বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু যেভাবে বেড়ে চলেছে তা খুবই ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। আর তাই এখনই সতর্ক হয়ে মশানিধন কর্মসূচি সফলভাবে পরিচালনা করা না গেলে পরিস্থিতি ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মশা নিধনের কোনো বিকল্প নেই। দ্রুত মশা নিধনের জন্য ক্রাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে হবে। উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে অন্তত পরিস্থিতি কিছুটা ভালো করা যেতে পারে। এমন কিছু করা না গেলে পরিস্থিতি হতে পারে ভয়াবহ।
আগস্টে বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যাও
দেশে চলতি বছরের জুন মাসে ৭৯৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। এর মাঝে আট জন মারা যান। তবে জুলাই মাসে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় দুই হাজারের বেশি। এই মাসে দেশে দুই হাজার ৬৬৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়, যার মাঝে মৃত্যু হয় ১২ জনের।
আগস্ট মাসে এসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ছয় হাজারের বেশি। এই মাসে দেশে ছয় হাজার ৫২১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। এর মাঝে ২৭ জন দেশের বিভিন্ন স্থানে মারা যায়। এরই ধারাবাহিকতা দেখা যায় সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই দিনেও। এই দুই দিনে দেশে ৭৬৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর মাঝে চার জন মারা যাওয়ার তথ্য জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর যে ঊর্ধ্বমুখী চিত্র দেখা যায়, সেটার ধারাবাহিকতা বজায় ছিল চলতি বছরের জানুয়ারিতেও। মোট এক হাজার ৫৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী জানুয়ারি মাসে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। এর মাঝে ১৪ জন মারা যান।
তবে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই সংখ্যা কমে আসতে থাকে। এই মাসে ৩৩৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এর মাঝে তিন জন মারা যান। মার্চে মাসে দেশে ৩১১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। যার মাঝে পাঁচ জন মারা যাওয়ার তথ্য জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এপ্রিলে ৫০৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়ম যার মাঝে দুই জন মারা যান। মে মাসে ৬৪৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মাঝে ১২ জন মারা গেছেন।
চলতি বছর সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭ জনে। এর মধ্যে নারী ৪৭ জন এবং পুরুষ ৪০ জন। মোট মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাইরে মারা গেছেন ৩৬ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ হাজার ৬০৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাইরে সাত ৮৮৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন হাসপাতালে তিন হাজার ৪৯৭ জন ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন হাসপাতালে দুই হাজার ২২৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ২৮৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন আছেন।
পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার সারাবাংলাকে বলেন, ‘হটস্পট ব্যবস্থায় ব্যর্থ হওয়ার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগী যেসব এলাকা থেকে বেশি আসে, সেখানে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। দরকার হলে সেখানে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। এতে এক রোগী থেকে অন্য রোগী আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে আসে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। যদি এমনটা না হয় তবে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকার সব জায়গায় ডেঙ্গু রোগীর হার সমান নয়। যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি, সেখানে মশক নিধনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। মাইকিং, জনসচেতনতা, ওষুধ ছিটানো— সবকিছু একসঙ্গে করতে হবে। এমনটা না করতে পারায় এখন পর্যন্ত জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন কিন্তু ডেঙ্গু শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি প্রায় সারা দেশেই ছড়িয়েছে। আর তাই সারা দেশেই স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে। না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। এখন থেকেই আমাদের মশার প্রজনন ঠেকাতে হবে। মশার প্রজনন যদি আমার মৌসুমের শুরুতেই ঠেকাতে পারি, তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।’
কবিরুল বাশার বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। বাসা বাড়ি বা আশপাশে যেন পানি জমা না থাকে, পানি জমার মতো কোনো পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, কোথাও যেন পরিত্যক্ত টায়ার বা কোনো ধরনের পাত্র পড়ে না থাকে, এই বিষয়ে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
ধ্বংস করতে হবে মশার প্রজননক্ষেত্র
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু যে দেশে ঢোকে, সেখান থেকে বের হয় না। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের দেশে দুই যুগের বেশি সময় ধরে এটি নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ করা হয়নি। ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলেও এর নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি একটি সঠিক কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গুর বাহক যে এডিস মশা, তাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে তো ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটতেই থাকবে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলের জন্য সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে যে একটি সমন্বিত অভিযানের দরকার, সেটা আসলে পরিকল্পনাও করা হয়নি, শুরুও করা হয়নি। ওষুধ মাঠপর্যায়ে কতটা কার্যকর, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সব মিলিয়ে একটা বিষয় পরিষ্কার, ডেঙ্গুর বাহক যে এডিস মশা, সেটা দমন বা নির্মূল করার ব্যর্থতার জন্যই মূলত ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইতোমধ্যেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যেসব এলাকায় রোগী আছে সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম