Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অন্তর্বর্তী সরকার: সংস্কার, রদবদল আর শৃঙ্খলা ফেরানোর এক মাস

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২৩:৩৭

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের একটি বৈঠক। পিআইডি ফাইল ছবি

ঢাকা: স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম রাজনৈতিক বাঁকবদল। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের টানা দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনের অবসান। সেখান থেকে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে শান্তিতে নোবেলজয়ী একমাত্র বাংলাদেশি নাগরিক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যে ছাত্রদের হাত ধরে শেখ হাসিনা সরকারের পতন, সেই ছাত্রদের দুজন প্রতিনিধিও সরাসরি উপস্থিত সরকারে। বহুমুখী ঘটনাপ্রবাহে সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক মাস পূর্ণ হলো।

বিজ্ঞাপন

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর ৮ আগস্ট রাতে শপথ নেয় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর প্রশাসন, পুলিশ থেকে শুরু করে প্রায় সব খাতেই দায়িত্বশীল পদগুলোতে এসেছে পরিবর্তন। আর্থিক খাত সংস্কার করতে গিয়ে নাজুক অবস্থায় থাকা বেশ কিছু ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বেও এসেছে পরিবর্তন।

এদিকে অপসারণ করা হয়েছে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা শুরু না হলেও নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের আলোচনা চলছে জোরেশোরেই। এর মধ্যেই এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শতভাগ কাজে ফেরানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে সরকারকে। সবকিছুর মধ্য দিয়ে। এক মাস সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস ডাক দিয়েছেন ঐক্যের। বলেছেন, তরুণ প্রজন্ম যে বৈষম্যহীন, নিপীড়নমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশেল স্বপ্ন দেখে তা পূরণ করতে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

যেভাবে গঠন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ১ জুলাই থেকে রাজপথে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় সেই আন্দোলন আরও প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। ১৬ জুলাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছা্ত্রলীগের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ ঘটে সারা দেশে। রংপুর, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় প্রাণহানি ঘটে ছয়জনের। এরপর আর সংঘাত থামেনি। শত শত প্রাণহানি আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। শেষ পর্যন্ত ৩ আগস্ট আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফায়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঢাকামুখী রোড মার্চের কর্মসূচির দিন দুপুরে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।

বিজ্ঞাপন

ওই দিন রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা ঘোষণার করা কথা বলেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। পরে মধ্যরাত পেরিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানান, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন হবে এ সরকার। ৬ আগস্ট বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়।

৮ আগস্ট দুপুরে ফ্রান্সের প্যারিস থেকে দেশে ফেরেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সন্ধ্যায় তার নেতৃত্বে আরও ১৬ জন উপদেষ্টা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সেদিন রাতেই বঙ্গভবনে অধ্যাপক ইউনূসসহ ১৪ জন শপথ নেন। পরে শপথ নেন আরও তিনজন। ১৬ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারে যুক্ত হন আরও চারজন। সব মিলিয়ে এখন ২০ জন উপদেষ্টাসহ ২১ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে চলছে দেশ।

যারা রয়েছেন উপদেষ্টা পরিষদে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার অধীনে রয়েছে চারটি মন্ত্রণালয়সহ সরকারি ছয়টি দফতর। এগুলো হলো— মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, খাদ্য মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।

সরকারের বাকি ২০ উপদেষ্টা হলেন— ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, আলী ইমাম মজুমদার, ড. আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান খান, হাসান আরিফ, তৌহিদ হোসেন, সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান, মো. নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সুপ্রদিপ চাকমা, ফরিদা আখতার, বিধান রঞ্জন রায়, আ ফ ম খালিদ হাসান, নুরজাহান বেগম, শারমিন মুরশিদ ও ফারুক-ই-আজম।

ব্যাপক রদবদলে শুরু সরকারের কার্যক্রম

শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর শুরুতেই পুলিশ-প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতের বিশেষত শীর্ষ নেতৃত্বে ব্যাপক রদবদলের মাধ্যমে শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম। প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করলে তার জায়গায় নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নতুন অ্যাটর্নি জেনারেলও।

বদল আনা হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) পদে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিবদেরও পরিবর্তন করা হয়। নতুন গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। বিভিন্ন অধিদফতরসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মহাপরিচালক ও পরিচালক পদেও আনা হয় নতুন মুখ। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানেও শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকেই পদত্যাগ করেছেন। স্বেচ্ছায় হোক কিংবা বিক্ষোভ বা চাপের মুখেই হোক, সেসব পদে এসেছে নতুন নিয়োগ।

আন্দোলনে প্রাণহানির তদন্তে জাতিসংঘ

দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সরকার বলে আসছে, তাদের অন্যতম প্রথম কাজ জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে চলাকালে সহিংসতা ও প্রাণহানি তথা গণহত্যার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা। সরকারের উদ্যোগে এরই মধ্যে জাতিসংঘ এই তদন্ত কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের একটি প্রতিনিধি দল এক সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশ সফরও করে গেছে। তারা বলেছে, আন্দোলনে অন্যায্যভাবে বলপ্রয়োগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এরপর তদন্তের জন্য দেশে আসবে জাতিসংঘের একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেছেন, সরকার জুলাই-আগস্টে আন্দোলন চলাকালে প্রাণহানির ঘটনা তদন্তে জাতিসংঘকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তারা তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বড় চ্যালেঞ্জ

শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় ছিল দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ৫ আগস্ট ও এর আগের কয়েকদিনে দেশের থানাগুলোর তিন ভাগের প্রায় দুই ভাগই আক্রমণ-হামলা-ভাঙচুরের শিকার হয়। অনেক থানা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অস্ত্র-মালামাল লুট করা হয়। পুলিশ সদস্যদের অনেকেই চলে যান আত্মগোপনে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর থেকে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরের কয়েকদিন পর্যন্ত কোনো থানাতেই পুলিশ সদস্যদের পাওয়া যায়নি। উলটো পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে নিরাপত্তাসহ নানা দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেন।

ওই সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে শুরু করে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ছিল না বললেই চলে। এলাকায় এলাকায় স্থানীয়রা রাত জেগে পাহারা দিতে শুরু করেন। শিক্ষার্থীরা শুরু করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ। আলোচনার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত ১১ আগস্ট পুলিশকে কাজে ফেরাতে সমর্থ হয় সরকার। এখনো দেশের সব থানা শতভাগ সক্ষমতায় না ফিরলেও পুলিশ বাহিনী স্থিতিশীল অবস্থার দিকে হাঁটছে।

আর্থিক খাতে সংস্কার

শপথ নেওয়ার পর সরকার যেসব কাজকে অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করে তার মধ্যে অন্যতম আর্থিক খাতকে শৃঙ্খলায় ফেরানো। এর অংশ হিসেবে নতুন গভর্নর নিয়োগ দিয়েছে সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের পর নতুন গভর্নর ১০টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছেন। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান পদেও আনা হয়েছে নতুন মুখ।

এদিকে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মোবাইলে আর্থিক সেবা নগদের। শেয়ারবাজারে বেক্সিমকো, লা মেরিডিয়ান হোটেলসহ ১২ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। ডলারের দাম আরও বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। আগের সরকারের আমলে আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারি, অনিয়ম ও দুর্নীতি উদ্‌ঘাটন করতে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননী ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে।

দুর্নীতির অনুসন্ধান

নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৬ বছর মেয়াদের সুবিধাভোগী বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে। সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্যসহ আওয়ামীপন্থি অনেক ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। পুলিশ, সেনা কর্মকর্তাসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন এ তালিকায়।

সম্পদ পাচার নিয়েও শুরু থেকেই সক্রিয় সরকার। বেক্সিমকো গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপ ছাড়াও চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারে অভিযোগ অনুসন্ধান করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ। শেয়ার বাজারের দুর্নীতির অনুসন্ধানের কথা আগেই বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় অর্ধশত মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে নানা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে পরিবর্তন এলেও দুদকে এখন পর্যন্ত পরিবর্তন আসেনি।

স্থানীয় সরকারে জনপ্রতিনিধি অপসারণ

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের ব্যবধানে দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র এবং জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অবশ্য ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) হাত দেয়নি সরকার। সেগুলোর চেয়ারম্যানরা নিজ পদে বহাল রয়েছেন। তবে যেসব স্থানে ইউপি চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত, সেসব স্থানে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালন করতে বলেছে সরকার।

মামলা ও মামলা প্রত্যাহার

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর একদিকে যেমন আগের অনেক মামলা প্রত্যাহার হয়েছে, তেমনি মামলা দায়েরেরও হিড়িক পড়েছে। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে দায়ের করা সব ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে সরকার। এ ছাড়া সন্ত্রাস দমন আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলোও দ্রুত প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নেবে বলে সরকার জানিয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সরকার বিদায়ের ঠিক আগে আগে জামায়াত ইসলামী ও এর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিন, ২৮ আগস্ট সেই প্রজ্ঞাপনও বাতিল করা হয়েছে।

এদিকে ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলমান আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে শত শত মামলা হয়েছে। এর মধ্যে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই হত্যা মামলা হয়েছে শতাধিক। আওয়ামী লীগের শীর্ষ অন্য নেতাদের নামেও দেশের বিভিন্ন স্থানে ডজন ডজন হত্যা মামলা হয়েছে। অনেক মামলায় আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও বোন শেখ রেহানাকেও।

গ্রেফতার

এদিকে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী-সংসদ সদ্যসহ সাবেক অনেক সরকারি কর্মকর্তাও এর মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতার সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন— সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, শাহাজান খান, টিপু মুনশি, দীপু মনি, জুনাইদ আহমদ পলক, শামসুল হক টুকু, এবি তাজুল ইসলাম, আব্দুর রহমান বদি, আরিফ খান জয়। আওয়ামী লীগ নেতা আহমদ হোসেন, ছাত্রলীগ নেতা তানভীর হাসান সৈকতসহ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের আরও অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন।

এদিকে গ্রেফতারের তালিকায় রয়েছেন পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেলের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান, চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকসহ আরও অনেকেই।

শিক্ষা

দীর্ঘ দিন বন্ধের পর শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপউপাচার্য, প্রক্টরসহ প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে পদত্যাগের হিড়িক পড়ে। এর মধ্যে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই উপাচার্যসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগও দিয়েছে সরকার। ইউজিসি চেয়ারম্যান পদেও এসেছে নতুন নিয়োগ।

এদিকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে এ বছরের এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করেছে সরকার। পরীক্ষার্থীদের অটো পাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বড় ধরনের পরিবর্তনের কথাও জানিয়েছে সরকার। মাধ্যমিকে আবারও বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ বিভাজন ফিরে আসবে। বদলে যাবে পাঠ্যপুস্তক। মূল্যায়ন পদ্ধতিও ২০১২ সালের পদ্ধতির কাছাকাছি কোনো একটি স্থানে ফিরবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

দাবির শহর ঢাকা

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই দাবিদাওয়ার বহর নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে প্রায় সব শ্রেণিপেশার মানুষ, গোষ্ঠী ও সংগঠন। সরকার গঠনের পরের তিন সপ্তাহে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ের সামনে যেমন, তেমনি প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনেও দাবির লাইন লেগে যায়। চলতে থাকে বিক্ষোভ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘেরাও করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে আনসারদের ‘বিদ্রোহ’, যার অবসান ঘটে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে।

ওই ঘটনার পরপরই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, সচিবালয়, বিচারপতির সরকারি বাসভবন, বিচারপতি ভবন, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ ও মৎস্য ভবনসংলগ্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ না করার নির্দেশনা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। পরে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছেন, সরকার সবার দাবি-দাওয়াই শুনতে ইচ্ছুক ও পূরণ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তবে সেগুলো রাস্তায় আন্দোলন-বিক্ষোভের মাধ্যমে না জানিয়ে লিখিতভাবে জানাতে অনুরোধ করেন তিনি।

সরকারের নানা সিদ্ধান্ত

দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এক মাসে বেশকিছু আইন পরিবর্তনসহ নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি নির্বাহী আদেশ জারি করতে হয়েছে সরকারকে। এরই মধ্যে ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ -এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এর ফলে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের আর কোনো সদস্য রাষ্ট্রীয় বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা পাবেন না। এর আগে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের সাধারণ ছুটি বাতিল করা হয়।

এদিকে সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণ বিষয়ে আইনি কাঠামো ঠিক করতে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত গণভবনকে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার। সরকারের সব পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি নিতে সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এর মধ্যেই গুমের বিভিন্ন অভিযোগ ও ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন করেছে সরকার। পাশাপাশি গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদেও বাংলাদেশ সই করেছে।

রাজনীতি ও নির্বাচন

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি হয়েছে সেটি হলো— ‘কবে হবে জাতীয় নির্বাচন’। দায়িত্ব নেওয়ার পর এরই মধ্যে সরকার সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তাদের কাছ থেকে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংস্কারের নানা পরামর্শ শুনেছে। তবে প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কার করে তবেই নির্বাচন আয়োজন করবেন তারা।

প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের গুরু দায়িত্ব নিয়েই সরকার পরিচালনা করছেন তিনি। সেই সংস্কারের জন্য সরকারকে সময় দিতে হবে। তবে নির্বাচন কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে। তারা বললেই সরকার নির্বাচন আয়োজন করবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নির্বাচন আয়োজন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এর আগে একাধিক দফায় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিএনপি বলছে, যত দ্রুতসম্ভব ভোট আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার প্রধান উপায়। বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও যত দ্রুতসম্ভব নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দেওয়ার কথাই বলেছে।

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের একমাসের মাথায় ৫ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। ওই দিনই তার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করেছে, যা রাষ্ট্রপতি গ্রহণও করেছেন বলে রাতে নিশ্চিত করেছে বঙ্গভবনের প্রেসউইং। এ পরিস্থিতিতে এই মুহূর্তে দেশে নির্বাচন আয়োজনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউই নেই। নির্বাচনের দিতে যেতে হলে প্রথমে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, যেখানে নির্বাচন কমিশন আইনের সংস্কার প্রয়োজন হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করার আগে আগে অবশ্য নতুন তিনটি রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দিয়ে গেছে। এর মধ্যে দলীয় প্রতীক ট্রাক দিয়ে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের দল গণঅধিকার পরিষদকে। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্নার দল নাগরিক ঐক্যকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে কেটলি প্রতীকে। আরও নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কিছু নেতার উদ্যোগে গঠিত আমার বাংলাদেশ পার্টি বা এবি পার্টিকে। তাদের দলীয় প্রতীক ঈগল।

কোন পথে সরকার

এদিকে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন ঘিরে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সরকারে রয়েছেন সেই ছাত্রদের দুজন প্রতিনিধি— দুই উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এর এর বাইরে ছাত্রদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক অটুট রাখতে গড়ে তোলা হয় লিয়াজোঁ কমিটি। সেই কমিটির সমন্বয়ক ছিলেন মাহফুজ আলম। পরে তাকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করে চলেছেন। সমন্বয়করা বলছেন, বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা যেন সরকারের কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হয়, সেটি তারা নিশ্চিত করবেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো সরকারের কর্মকাণ্ড যাচাইয়ের জন্য এক মাস কখনোই পর্যাপ্ত সময় নয়। বিশেষ করে সরকার যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সেটি স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় যোজন যোজন বেশি চ্যালেঞ্জিং। তা সত্ত্বেও সরকার আর্থিক খাত সংস্কার, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ আয়োজনসহ যেসব পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে, সেগুলোর ধীরগতির হলেও বহুল সমালোচিত হওয়ার মতো নয়।

প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, সরকার এমন একটি দেশ গড়তে চায়, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। লক্ষ্য একটাই— উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার এই প্রত্যাশা অনুসরণ করে সরকার পথ চললে সেটি সরকারকে সাফল্যের পথেই এগিয়ে দেবে।

সারাবাংলা/টিআর

অন্তর্বর্তী সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগ সরকার আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গণহত্যা ছাত্র আন্দোলন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান জাতিসংঘের তদন্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূস নাহিদ ইসলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মাহফুজ আলম শেখ হাসিনা সরকার পতন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর