নতুনভাবে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা, সীমান্তে সক্রিয় দালাল চক্র
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:৪৬ | আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:১২
কক্সবাজার: মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলা সংঘাতে নাফ নদীসহ দীর্ঘ সীমান্তের নানা পয়েন্ট দিয়ে নতুনভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। তাদের অবৈধভাবে এদেশে আসতে সহযেগিতা করছে দুই পারের দালাল চক্র।
এদিকে, অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী কঠোর অবস্থানে থাকলেও তাদের ফাঁকি দিয়েই চলছে অনুপ্রবেশ। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিচ্ছে পুরাতন রোহিঙ্গা স্বজনদের কাছে। সদ্য আসা রোহিঙ্গাদের কারণে ক্যাম্পে সৃষ্টি হয়েছে থাকা-খাওয়া নিয়ে সংকট।
গত সপ্তাহ থেকেই মিয়ানমারের বন্দর শহর মংডুতে আবারও তীব্র লড়াই শুরু হয়েছে সে দেশের সেনাবাহিনী ও আরকান আর্মির মধ্যে। যা এপারের সীমান্ত থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে। গত রোববার থেকে গোলাগুলিসহ বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য।
ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের তথ্য জানা যায়, সেনাবাহিনী ও আরকান আর্মির মধ্যে চলমান যুদ্ধে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে রাখাইন রাজ্য মংডুতে থাকা রোহিঙ্গাদের। রোহিঙ্গাদের হত্যার পাশাপাশি পুড়িয়ে দিচ্ছে তাদের ঘর-বাড়ি। এ অবস্থায় রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে নাফ নদীসহ বিস্তীর্ণ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এদেশে পালিয়ে আসছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতারা জানান, এরই মধ্যে ১০ থেকে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা এদেশে পালিয়ে আসছে। ওপারে অপেক্ষায় আছে আরো প্রায় অর্ধলাখ। আর এসব রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসতে সহযোগিতা করছে দুই পারের দালাল চক্র। যারা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সাও হাতিয়ে নিচ্ছে।
এদিকে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি-কোস্টগার্ড কঠোর অবস্থানে রয়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে। তারা সীমান্ত থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পাশাপাশি আটক করছে দালালদের। কিন্তু ঠিকই দীর্ঘ সীমান্তের কোন না কোন পয়েন্ট দিয়ে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গারা ঢুকে পড়ছে। তারা এদেশে এসে ক্যাম্পের পুরাতন রোহিঙ্গা স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিচ্ছে। এদিকে বাড়তি রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়া নিয়ে ক্যাম্পে সৃষ্টি হয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ।
পুরনো রোহিঙ্গারা বলছেন, জীবন বাঁচাতে তাদের দেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা আত্মীয়-স্বজন ও স্বজাতিদের আশ্রয় দিলেও থাকা-খাওয়া ভাড়াভাড়ি করতে গিয়ে পড়তে হচ্ছে অসুবিধায়। তারা নতুনদের জন্যও সহযোগিতা কামনা করছে।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জাফর আলম বলেন, ‘জীবন বাচাঁনোর জন্য রোহিঙ্গারা এদেশে চলে আসছে। তারা আমাদের আত্মীয়-স্বজন এবং একই জাতের। তাদের আমরা আশ্রয় দিচ্ছি। ছোট্ট ঘরে একসাথে থাকতে দিচ্ছে, ভাগাভাগি করে খাবার খাচ্ছি। কিন্তু আমরা নিজেরাই থাকা-খাওয়া নিয়ে কষ্ট আছে। তাই এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা করছি নতুন আসা রোহিঙ্গাদেরও যেন আমাদের মত থাকা-খাওয়ার নিরাপদ ব্যবস্থা করে দেয়।’
আরেক রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, ‘আমরা নিজেরাই জনপ্রতি মাসে ১৩০০ টাকা রেশন পাই। যা দিয়ে চলা খুবই কষ্ট। তাই বলে আমাদের কাছে আশ্রয়ে আসা রোহিঙ্গা ভাই-বোনদের তো ফেলে দেওয়া যাবে না। আমরা তাদের না দেখলে কে দেখবে? তারা বিপদ থেকে বাচাঁর জন্য আমাদের কাছে আসছে। আর আমরাই যদি বিপদে ফেলে দেই তাহলে কেমনে হবে। এই অবস্থায় তাদেরকেও সহযোগিতা করা দরকার। নয়ত সবাই কষ্টে পড়ে যাব।’
সদ্য আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, সেনাবাহিনী এবং আরকান আর্মিদের মধ্যে চলা যুদ্ধে মিয়ানমারে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে তাদের জীবন। তাই বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচাতে এদেশে পালিয়ে এসেছে। দুই পারের দালালদের সহযোগিতায় পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও তাদের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে দালাল সিন্ডিকেট।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক আত্মীয়ের বাসায় অবস্থান নেওয়া নতুন রোহিঙ্গা নুর কায়দা জানান, মগেরা মংডুতে তাদের ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দিয়েছে। জীবন বাচাঁনোর জন্য ঝুঁকি নিয়ে হলেও ৪ সন্তান আর স্বামী নিয়ে এদেশে পালিয়ে এসেছে। তারা নাফ নদী পয়েন্ট হয়ে এসেছেন। নদী পার হয়ে এদেশে আসার জন্য দুই পাড়ের দালালদের মিয়ানমার এবং বাংলা টাকা মিলে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিতে হয়েছে।
আরেক নতুন রোহিঙ্গা বজিমুল হাসান বলেন, ‘যুদ্ধ চললেও নিজ দেশ মিয়ারমার থেকে আসতে চাইনি। মংডুতে আমার এক ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমার ভাইয়ের মেয়ের শরীরে এখনো গুলির চিহ্ন রয়েছে। আমরা জীবন বাঁচানোর জন্য এই দেশে পালিয়ে এসেছে। এখানে আমার এক বোন ২০১৭ সালে পালিয়ে এসেছিল। আমরা তাদের কাছেই অবস্থান নিয়েছি।’
উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন জানান, এমনিতেই রোহিঙ্গারা এদেশের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার মধ্যে নতুন রোহিঙ্গা কোনভাবেই কাম্য নয়। এতে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সেবাদানকারীদের বাড়তি চাপে পড়তে হবে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তরক্ষীদের আরো কঠোর হওয়া দরকার। তবে যারা চলেই এসেছে তাদের প্রতি অমানবিকও হওয়া যাবে না।
এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি কোন মন্তব্য করেননি।
সীমান্তে কড়াকড়ির মাঝে কিভাবে এতো রোহিঙ্গা নতুন করে অনুপ্রবেশ ঘটছে তা নিয়ে কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের পক্ষ থেকে। বিজিবি’র টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে টহল জোরদার রয়েছে। প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে একজন রোহিঙ্গাও যেন অনুপ্রবেশ করতে না পারে। এছাড়া দালালদের বিরুদ্ধেও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সারাবাংলা/এমও