১০ম গ্রেড আন্দোলন: অডিটরদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা!
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৯:৪৮
ঢাকা: সদ্য ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সমালোচিত বিষয় ছিল বিরোধীদল ও মতের মানুষের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দায়ের। কিন্তু সেই সরকারের পতন হলেও রয়ে গেছে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া। এবার অভিযোগ উঠেছে, রাজধানীর রমনা থানার পুলিশ বাদী হয়ে অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগের ১৬ অডিটরের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দায়ের করেছেন। শুধু মামলা করেই ক্ষান্ত হননি তারা; এরই মধ্যে তাদের গ্রেফতারের জন্য সিএজি বরাবর আবেদনও করেছেন।
সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অডিটর পদকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করার দাবিতে ৪৫ দিন ধরে অহিংস আন্দোলন করে আসছিলেন অডিটররা। কিন্তু তাদের দাবি মানা হয়নি, বরং এখন অডিটরদের শাস্তিমূলক বদলি ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। অডিটর পদকে ১০ম গ্রেডে উন্নীতের দাবিতে আন্দোলনরত অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বিষয়টি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, গত ২২ সেপ্টেম্বর দুপুর আড়াইটায় রাজধানীর কাকরাইলে বিচারপতির বাসভবন সংলগ্ন অডিট ভবনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে যান কয়েকশ’ অডিটর। কিন্তু তার আগেই ভবনের প্রধান গেইট বন্ধ করে সেখানে সেনাবাহিনী ও পুলিশ অবস্থান নেয়। ফলে অডিটররা সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি। পর তারা গেইটসংলগ্ন রাস্তায় অবস্থান নেয়। এতে করে সেখানে সাময়িক যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ উপস্থিত হয়ে মৃদু লাঠিচার্জ ও জলকামান ব্যবহার করে তাদের সরিয়ে দেন।
এর পর ওইদিন সন্ধ্যায় রাজধানীর রমনা থানার উপপরির্দশ (এসআই) হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে ১৬ অডিটরসহ অজ্ঞাতনামা ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, গেইটে ধাক্কাধাক্কি এবং পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। একইদিন রমনা থানার আরেক এসআই সালাউদ্দিন আসামিদের গ্রেফতারের জন্য ডেপুটি কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিনিয়র) বরাবর আবেদন করেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো আসামি গ্রেফতার হয়নি।
জানা গেছে, মামলার ১ নম্বর আসামি অহিদুল রহমান ডালিম ঘটনার দিন গ্রামের বাড়ি বগুড়া থেকে ঢাকা আসেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগে অডিট ভবনের কর্মসূচি শেষ হয়ে যায়। এ সংক্রান্ত প্রমাণ সারাবাংলার হাতে রয়েছে। অন্যদিকে, মামলার ৩ নম্বর আসামি রংপুর ডিসিএ অফিসের অডিটর মিজানুর রহমান ঘটনার দিন অফিস করেছেন। যার প্রমাণও প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। এ ছাড়াও মামলার ২ নম্বর আসামি মিজানুর রহমান ঘটনার দিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না বলেও জানা গেছে।
এ ব্যাপারে অডিটর অহিদুর রহমান ডালিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না। ঘটনার দিন আমি বগুড়া থেকে ঢাকা আসি। অডিট চত্বরে আসতে আসতে আসতে বিকেল ৪টা বেজে যায়। ততক্ষণে অডিটরদের অবস্থান কর্মসূচি শেষ। তারপরও পুলিশ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিয়েছে। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, পুলিশের দিকে অডিটররা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেছে। অথচ এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং পুলিশ আমাদের অহিংস আন্দোলনে হামলা করেছে। অনেক অডিটর আহত হয়েছেন।
এদিকে, গায়েবি মামলা দায়ের প্রসঙ্গে মামলার বাদী রমনা থানার এসআই হাবিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তা দেখবেন। এটা দেখার দায়িত্ব আমার না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আসামিদের মধ্যে কে ঢাকার বাইরে ছিলেন, আর কে ভেতরে ছিলেন- এটা তদন্ত কর্মকর্তা দেখবেন। আমি সিনিয়র স্যারদের সিদ্ধান্তে মামলা করেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না।’
অডিটরদের অভিযোগ, আন্দোলন দমাতে সিএজি অফিস ও অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগের নন ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তিমূলক বদলি শুরু করেছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৬৪ জনকে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে ভিন্ন ভিন্ন অফিস আদেশে রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি করা হয়েছে। এই বদলিকে অন্যায় ও প্রতিহিংসামূলক আচরণ হিসেবে দেখছেন নন ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের অভিযোগ, আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন করায় গণবদলি করে সিএজি রায় অমান্য করেছে।
জানা গেছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর একটি রিট মামলার পক্ষভুক্ত ৬১ জন অডিটরের বেতনস্কেল গ্রেড-১১তম থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা হয়। পরবর্তী সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে রিট মামলায় পক্ষভুক্ত ৬১ জন অডিটরের বেতনস্কেল গ্রেড-১১ থেকে গ্রেড-১০ এ উন্নীত করা হয়। তারপরেও নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগের অডিটর পদটিকে ১০ গ্রেডে (সেকেন্ড ক্লাস) গেজেটেড পদে উন্নীত না করে কেবল রিট পিটিশনকারী ৬১ জন অডিটরের বেতন স্কেল গ্রেড-১১ থেকে গ্রেড-১০ এ উন্নীত করা হয়।
পরে এ বিষয়ে আদালত অবমাননা অভিযোগ দায়ের করলে সর্বোচ্চ আদালত ২০২২ সালে অডিটরদের গ্রেড-১০ (সকল অডিটর) এ উন্নীত করার পক্ষে রায় দেন। সর্বশেষ চলতি বছরের গত ১২ আগস্ট সিএজি দফতর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের প্রশাসন ও অনু বিভাগ থেকে তা আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনাটি পাঠানো হলে আইন মন্ত্রণালয় অডিটরের বেতন স্কেল গ্রেড-১১ থেকে গ্রেড-১০ এ উন্নীত করার বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। তারপরেও সিএজি তা বাস্তবায়ন করেনি।
উল্লেখ্য, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) ও এর অধীন হিসাব মহানিয়ন্ত্রক (সিজিএ), কন্ট্রোলার জেনারেল ডিফেন্স ফাইন্যান্স (সিজিডিএফ) ও রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের চার প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে অডিটর হিসেবে কর্মরত আছেন ছয় হাজার ৯৮৫ জন। এর মধ্যে মাত্র ৬১ জনকে হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে, যারা রিট মামলার পক্ষভুক্ত হয়েছিলেন, শুধু তাদের ১০ম গ্রেডে বেতন দেওয়া হয়। বাকিরা এখনও ১১তম গ্রেডে বেতন পান। কিন্তু অডিটরদের দাবি, আদালতের রায় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৬১ জনকে নয়, সব অডিটরকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করতে হবে। এটি না করা আদালত অবমাননার শামিল।
এ বিষয়ে অডিটর জেনারেল মো. নুরুল ইসলাম এবং উপ-মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিনিয়র) এস এম রিজভীকে একাধিক বার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। ফলে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সারাবাংলা/জিএস/পিটিএম