পাঠ্যপুস্তক কমিটি বাতিলে মৌলবাদের সঙ্গে সরকারের আপস দেখছে টিআইবি
১ অক্টোবর ২০২৪ ০১:২৩
পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য কমিটি গঠন করেও সেই কমিটি বাতিল করার ঘটনাকে মৌলবাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আপসকামী মনোভাব অভিহিত করে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সংস্থাটি বলছে, নীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্বার্থান্বেষী মৌলবাদী হুমকির কাছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আপস করে উদ্বেগজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এনসিটিবির প্রণীত ও মুদ্রিত সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিলের সিদ্ধান্ত বৈষম্যহীন ‘নতুন বাংলাদেশে’র স্বপ্ন ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিপন্থি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আপসকামী আচরণের পরিচায়ক।
সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ১টার দিকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ কথা বলেন।
এর আগে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রণয়ন ও মুদ্রণ করা সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গত ১৫ সেপ্টেম্বর গঠন করা সমন্বয় কমিটি বাতিল করে সরকার। কোনো কারণ না উল্লেখ করেই ২৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে জারি করা এক অফিস আদেশে কমিটি বাতিলের কথা জানানো হয়।
১৫ সেপ্টেম্বর গঠন করা ১০ সদস্যের ওই সমন্বয়ক কমিটিতে আহ্বায়ক ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম, সদস্যসচিব মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. ইয়ানুর রহমান।
কমিটির বাকি সদস্যরা ছিলেন— শিক্ষা গবেষক রাখাল রাহা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাসুদ আখতার খান, এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান, সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী ও সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক এ এফ এম সারোয়ার জাহান।
কমিটি গঠনের পর পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটিতে কমপক্ষে দুজন আলেমকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল ও সংগঠন এবং তাদের অনুসারীরা। ‘সমকামিতার সমর্থক’ অভিহিত করে দুই সদস্য অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন ও সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফাকে কমিটি থেকে অপসারণের দাবিও তোলেন তারা।
এই কমিটি বাতিল নিয়ে বিবৃতিতে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ছাত্র-জনতা এমন একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের সুযোগ তৈরি করেছে, যা ধর্মীয়-সামাজিক ও সাংস্কৃতিকসহ সব বৈচিত্র্য ও মতাদর্শের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে। ‘নতুন বাংলাদেশ’ বৈষম্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও সুশাসিত হবে; যেখানে ধর্মীয় বা অন্য কোনো মতাদর্শ কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না। কিন্তু আমরা আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করছি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বহুত্বের বিরুদ্ধে কুৎসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা ছড়িয়ে শঙ্কা ও হুমকির বাতাবরণ তৈরির প্রচেষ্টা ক্রমেই উৎকট রূপ ধারণ করছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, স্বার্থান্বেষী মহলের অপপ্রচার ও হুমকির প্রতি নতি স্বীকার করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আপস করছে। এর উদ্বেগজনক উদাহরণ হলো পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন সমন্বয় কমিটি বাতিলের ঘটনা। বিষয়টি একদিকে যেমন সরকারের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপসের উদাহরণ, অন্যদিকে তেমনি ‘নতুন বাংলাদেশে’র বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার প্রতি রীতিমতো প্রহসন।
ড. জামান বলেন, কর্তৃত্ববাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে উত্থিত অশুভ জবরদখলকারী সাম্প্রদায়িক মহল যতই অতি ক্ষমতায়িত আচরণ করুক, তাদের বৈষম্যমূলক আদর্শকে সমাজের ওপর বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার যত অপচেষ্টাই করুক, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চাই— বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল ধারা কোনোভাবেই এ ধরনের সাম্প্রদায়িক শক্তির বিকাশ ঘটতে দেবে না।
মৌলবাদের সঙ্গে আপসের পথ সরকার পরিহার করবে আশাবাদ জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতার মূল ভিত্তি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল ধারার বহুমত, অন্তর্ভুক্তি, সমঅধিকার ও অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ। এর প্রতি অটুট থেকে সরকার তার ওপর অর্পিত রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হবে এবং সব ধরনের অশুভ শক্তি, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী মহলের সঙ্গে আপসের পথ দৃঢ়ভাবে পরিহার করবে বলে আশা প্রকাশ করছে টিআইবি।