Monday 14 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আন্দোলনে আহতদের জন্য প্রতিশ্রুতি মুখেই, ‘বাস্তবে শূন্য’

আরফাতুল ইসলাম নাইম, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট
১৩ অক্টোবর ২০২৪ ১০:১৫

নাম দীপঙ্কর বালা। মাদারীপুর সরকারি কলেজ গণিত বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতক পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েছেন। ১৯ জুলাই সকালে আন্দোলনে যোগ দেন। দুপুর হতে না হতেই পুলিশের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয় তার পা। পরদিন ২০ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। এরপর আড়াই মাস পার হয়ে গেছে, কিন্তু এখনো অস্ত্রোপচার করাতে পারেননি।

দীপঙ্কর বালা সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিন মাস ধরে হাসপাতালে আছি। না পাইছি কোনো সাহায্য, না পাইছি স্বাস্থ্য সেবা। প্রায় তিন মাসেও এখনো অপারেশন করাতে পারেনি। এখন বলছে আগামী সোমবার করবে।’

বিজ্ঞাপন

অস্ত্রোপচার বা উন্নত চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার ক্ষোভ তো আছেই, দীপঙ্করের আরও বড় আক্ষোপ— দীর্ঘ আড়াই মাসেও সরকারের কোনো প্রতিনিধি কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক তার সঙ্গে যোাগযোগ করেননি। মানসিক এসব অপ্রাপ্তি-হাহাকার সঙ্গী করে শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে দীপঙ্কর হাসপাতালের শয্যায় কাতরাচ্ছেন।

দীপঙ্কর বালার মা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মেডিকেলে এসেছে দুই মাস হয়ে যাচ্ছে। কেউ আসলো না তারে দেখতে। তার বাপ হার্টের রোগী। কোনো ইনকাম নাই। পোলা টিউশন কইরা ঘর চালাইত। সেইটাও বন্ধ হয়ে গেছে। আমার পোলা কবে হাঁটতে পারবে, কবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে, কোনো নিশ্চয়তা নাই। সরকারি কোনো সহযোগিতা না পাইলে আমরা কেমনে চলব?’

শুধু দীপঙ্কর নয়, জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধসহ আহত এমন অনেকেই ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি আছেন, যারা কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পাননি। সরকার বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বশীল কেউই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।

বিজ্ঞাপন

আহতদের স্বজনরা বলছেন, ৫ অগাস্টের পর থেকে সমন্বয়করা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বারবার বলেছেন, তারা আন্দোলনে নিহতদের পাশাপাশি আহতদের তালিকা করা হচ্ছে। আহতদের সম্পূর্ণ সরকারি খরচে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। তাদের পরিবারদের সহায়তা করা হবে। কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সেসব প্রতিশ্রুতি মুখেই রয়ে গেছে, বাস্তবে তারা কিছুই পাননি।

কোনো ধরনের সহায়তা না পাওয়া এমন আরেকজন রমিজ উদ্দিন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে গত ২১ জুলাই হাতে, বুকে ও পিঠে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি আছেন। দুই মাসেও সুস্থতার কোনো লক্ষ্মণ নেই। বরং তার গুলিবিদ্ধ হাত পঙ্গু হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

রমিজের স্ত্রী চম্পা বেগম বলেন, ‘আমাগো দুইটা ছেলে-মেয়ে। আমার জামাই তো পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে গেছে। তার চাকরিও চলে গেছে। এই পঙ্গু স্বামী আর দুই পোলা-মাইয়া নিয়ে কেমনে চলব? তিন মাস হইতে চলল, কেউ আমাগো দেখতেই আসলো না!’

চম্পা বেগমের মতো আরও কয়েকজন নারীর দেখা মেলে ঢামেক হাসপাতালে, আহত স্বামীর পাশে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি হাসপাতালের বিছানায় থাকায় তাদের পরিবারের আয় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।

রমিজ উদ্দিন ঢামেক হাসপাতালের যে ওয়ার্ডে ভর্তি, সেই ওয়ার্ডেই থাকা আহত আরেকজন বললেন, ‘সবাই বলছে নতুন স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা তো আমাদের রক্তের ওপর দিয়েই এসেছে। অথচ আমরাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। সরকার ও সমন্বয়কদের দায়িত্ব আমাদের খোঁজ নেওয়া, ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। অথচ কেউ আমাদের দেখতেও আসলো না, কোনো খোঁজও নিল না।’

গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ের ঠিক আগের দিন ৪ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন জামাল হোসেন (৫২)। ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হলে অস্ত্রোপচার করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে ১৯ আগস্ট ফলোআপে গিয়ে জানতে পারেন, তার পায়ের ক্ষতস্থানে পচন ধরেছে। তখন থেকেই ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি তিনি।

জামাল হোসেন বলেন, ‘জুলাই থেইকা আন্দোলন করতাছি। ৪ তারিখে (৪ আগস্ট) যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হইয়া বেডে শুইয়া আছি। কোনো ইনকাম নাই। আমি লাশ গোসল করাই, আর কাফনের কাপড় বেচি। ধারদেনা কইরা দিন পার করতাছি। না আইছে কেউ দেখতে না, না করছে কোনো সাহায্য।’

সরকারের কোনো প্রতিনিধি, ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক কিংবা বিএনপি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কেউই তাদের দেখতে যাননি বলে জানান জামাল হোসেন। বলেন, ‘সরকার যদি আমাদের দায়িত্ব না নেয়, এই বয়সে ক্যামনে চলব? আমি সরকারের কাছে আহ্বান করি, যারা বয়স্ক তাদের জন্য যেন ভাতার ব্যবস্থা করে। আর যারা যুবক, তাদের জন্য যেন চাকরির ব্যবস্থা করে।’

ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি এক আহতের অভিভাবক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা রাজধানীর সর্বোচ্চ মেডিকেলে থেকেও যদি সাহায্য না পাই, তাহলে যারা স্থানীয় মেডিকেলে আছে তারা কি আদৌ সাহায্য পাচ্ছে? বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজ এত প্রাণ গেল, তাও কি বৈষম্য ঘুচল আমাদের?’

রমিজ উদ্দিন, দীপঙ্কর বালা ও জামাল হোসেনের মতো ঢামেক হাসপাতালের শয্যায় চিকিৎসা আর সহায়তার অভাবে করুণ সময় কাটছে আরও অন্তত ২১ জনের। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন আন্দোলনে আহতরা। অনেকে আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। নেই কোনো সহায়তা, নেই কোনো খোঁজখবরদারি। পরিবারের সদস্যরা ছাড়া কেউ তাদের দেখতে বা খোঁজখবর নিতে যাননি।

অথচ আন্দোলনে আহত ও নিহতদের সহায়তা দিতে সরকারিভাবে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া গত ২১ অগাস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে গঠন করা হয়েছে স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটি মেডিকেল টিম। কিন্তু এসব কমিটির পক্ষ থেকেও ঢামেক হাসপাতালে আহত কারও খোঁজ নেওয়া হয়নি।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, আন্দোলনের সমন্বয়কদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখা গেছে। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মতবিনিময়সহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। এমনকি একজন সমন্বয়কের বিয়ের খবরও এসেছে, বাকিরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই বিয়েতে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। কিন্তু কেউই আন্দোলনে আহতদের খোঁজখবর নিচ্ছেন না। এতে ক্ষোভ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

এদিকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ তুহিন ফারাবীকে নিজ জেলায় গিয়ে সংবর্ধনা নিতে দেখা গেছে। এর বাইরে তাকে বিশেষ কোনো কাজ করতে দেখা যায়নি।

এসব বিষয় নিয়ে জানতে স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য সচিব তারেকুল ইসলামের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

কারা সহায়তা করবে?

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকারি হিসেবে আহত ৩১ হাজারেরও বেশি। এদের মধ্যে অনেকেরই যেমন চিকিৎসা দরকার, তেমনি দরকার অর্থসহায়তা। কিন্তু সেটি হচ্ছে না বলেই সমালোচনা আছে। সরকার এরই মধ্যেই একটি ফাউন্ডেশন গঠন করে এক শ কোটি টাকা বরাদ্দও দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। কীভাবে পর্যাপ্ত তহবিল তৈরি হবে এবং সহায়তা কার্যক্রম চলবে, তাও কেউ জানে না।

ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি আহত ও তাদের স্বজনরা জানাচ্ছেন, তারা একজনও সরকারি কোনো তহবিল থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাননি। ফলে অর্থের অভাবে ধারদেনা করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার অনেকে টাকার অভাবে চিকিৎসা নিতেও পারছেন না বলে জানিয়েছেন।

এক শ কোটি টাকার তহলি কোথায় কাজে লাগানো হচ্ছে— জানতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, স্বল্প পরিসরে হলেও ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।

সরকারে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে থাকা উপদেষ্টা আসিফ বলেন, ‘ফাউন্ডেশন থেকে সরকার প্রাথমিক অনুদানটা দিয়েছে। এখন আমরা আহ্বান করেছি, দেশি-বিদেশি যারা যারা আছেন তাদের অনুদান দিতে। প্রাথমিকভাবে আপাতত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শহিদ পরিবারের জন্য পাঁচ লাখ টাকা, আহতদের জন্য সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। এরই মধ্যে সিএমএইচে (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল) যারা চিকিৎসাধীন, তাদের এক লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে আমরা তালিকা করছি। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সবাইকে টাকা পাঠানো হবে। আমরা সেসব তথ্য সংগ্রহ করছি।’

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হলে আহত-নিহতদের তালিকা প্রণয়নের কাজও শুরু হয়। একদিকে এই তালিকা এখনো শেষ হয়নি, অন্যদিকে তালিকার অপেক্ষায় সহায়তা কার্যক্রমও ব্যাপকভাবে শুরু করা যায়নি।

তালিকা তৈরিতে দেরি হচ্ছে কেন— জানতে চাইলে উপদেষ্টা আসিফ বলেন, এখনো অনেক প্রশ্নের সমাধানে আমরা আসতে পারিনি। তালিকাটা আগে তৈরি করতে হবে। এটা বড় একটি কাজ। এর জন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন। যেকোনো কারণেই হোক, উনারাও আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারেননি, আমরাও উনাদের কাছে পৌঁছাতে পারিনি।

সরকার বলছে, তালিকা হয়ে গেলেই দ্রুততম সময়ে আহত-নিহতদের মধ্যে যাদের সাহায্য দরকার তারা সেটা পাবে। কিন্তু এমন অনেক ভুক্তভোগীর খবর পাওয়া যাচ্ছে, যাদের সহায়তা দরকার এখনই। তাদের প্রশ্ন— সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না পেলে পরে সহায়তা দিয়ে কী করবেন!

সারাবাংলা/এআইএন/টিআর

আন্দোলন আন্দোলনে আহত ছাত্র আন্দোলন ছাত্র-জনতার আন্দোলন

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর