লিয়াজোঁ নাকি স্বতন্ত্র রাজনীতি— সিপিবিতে বিভক্তি
১৪ অক্টোবর ২০২৪ ১৫:১০
ঢাকা: ছাত্র-আন্দোলনের জের ধরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বাস্তবতায় নতুন করে রাজনৈতিক কৌশলের দিকে হাঁটছে দলগুলো। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অন্যতমস প্রাচীন বামপন্থি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও (সিপিবি) নিজেদের রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের চেষ্টা করছে। তবে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলটি যাত্রা কোন পথে হবে, তা নিয়ে দলের মধ্যে তৈরি হয়েছে বিভক্তি। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চলা দলটির একাংশ এখনো কোনো ‘বড় দলে’র সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে রাজনীতি করতে আগ্রহী। দলের আরেক অংশ বলছে, সিপিবিকে করতে হবে নিজস্ব রাজনীতি, কারও সঙ্গী হয়ে রাজনীতি করা যাবে না।
সিপিবির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদে সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিপিবিতে এই দুই পক্ষ অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই বিভিক্তি প্রকাশ্যে চলে আসে। এক পক্ষ মধ্যবর্তী কংগ্রেসের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন করে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের পক্ষে। অন্য পক্ষটি বিদ্যমান সমস্যাগুলো কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেই সমাধান করতে চায়।
দলটির একাধিক নেতাকর্মী বলছেন, সিপিবির নেতাকর্মীদের একাংশ ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সর্বাত্মক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এই আন্দোলনে পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তা ও আন্দোলনবিরোধী ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে আন্দোলনের সমর্থক এই অংশের। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে আন্দোলনকে সমর্থন করা নেতাকর্মীদের।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গত ১০ আগস্ট সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সভা হয়। সভায় গণঅভ্যুত্থানের মূল্যায়ন প্রশ্নে দলের দুই অংশের মধ্যে মতভেদ প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সরকারের পতন আন্দোলনকে ‘চরম প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ক্যু’ হিসেবে অভিহিত করলে আন্দোলনের সমর্থকরা তীব্র আপত্তি জানান। এই অংশটি গণঅভ্যুত্থানে ‘জনতার আকাঙ্ক্ষা, বিশেষত গণতান্ত্রিক দেশ ও সমাজ নির্মাণের প্রত্যাশা’কে প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক সংগ্রাম অগ্রসরের প্রস্তাব দেয়। শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই কেন্দ্রীয় কমিটির ওই সভা শেষ হয়।
সিপিবি সূত্র বলেছে, দলের একাংশের দাবি মধ্যবর্তী কংগ্রেস। এই কংগ্রেসের মাধ্যমে তারা বিরাজমান জটিলতা নিরসন করতে চায়। তবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সিপিবির পরবর্তী কংগ্রেস হওয়ার কথা ২০২৬ সালে। এ অবস্থায় পার্টির আরেক অংশ গঠনতন্ত্র অনুসরণ করে কংগ্রেসের জন্য ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার পক্ষে। তারা কেন্দ্রীয় কমিটির সভাতেই সব সমস্যার সমাধান চায়।
সূত্রের দাবি, সিপিবির বর্তমান ৪৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে ২৭ জন রয়েছেন এক পক্ষে, আরেক পক্ষে রয়েছেন বাকি ২১ জন। সিপিবি সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ ও দুঃস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ডা. দিবালোক সিংহ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আরেক পক্ষে রয়েছেন পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাজ্জাদ জহির চন্দন, জলি তালুকদারসহ অন্যরা।
এদিকে চলমান বিভক্তির মধ্যেই সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ‘ঘর গোছানো’র কথা ভাবছে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে ঢাকায় একটি মহাসমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তবে এর আগে সরকার পতন-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জনগনের আস্থা অর্জনে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এ লক্ষ্যে ১৮ অক্টোবর থেকে ২১ অক্টোর পর্যন্ত চার দিনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভা আহ্বান করা হয়েছে। সিপিবির বিভক্ত দুই অংশের নেতারাই মনে করছেন, এই বৈঠক থেকে পার্টির ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপথ স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সিপিবির অবস্থান জানতে চাইলে পার্টির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করা হবে। সিপিবি ১৯৯৪ সাল থেকে জাতীয় নির্বাচন পেশী শক্তি ও কালো টাকার প্রভবমুক্ত রেখে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দাবি করে আসছে। এ রকম নির্বাচন হলে সিপিবি কম-বেশি আসন পাবে। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে নির্বাচন হলে সিপিবি ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। তা না হলে আমরা বাম গণতান্ত্রিক জোটের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নেব।’
শাহ আলম জানান, দেশবাসীকে জানান দিতে আগামী ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির শুরুর দিকে মহাসমাবেশ করার চিন্তা রয়েছে। এর মাধ্যমে দিনমজুরসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে সিপিবির পতাকায় ঐক্যবদ্ধ করতে নেওয়া হবে পদক্ষেপ। এর আগে জেলা ও বিভাগীয় শহরেও সমাবেশ করা হবে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং রাজনৈতিক কৌশলে অন্য দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে জানতে চাইলে সিপিবি সভাপতি শাহ আলম বলেন, ‘সিপিবিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। তবে মতের পার্থক্য থাকতে পারে। আগামী কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় এসব মতপার্থক্য নিরসন করা হবে। সিপিবি ঐক্যবদ্ধভাবে মানুষের জন্য রাজনীতি করতে এগিয়ে যাবে।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর
ছাত্র-জনতার আন্দোলন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি রাজনৈতিক কৌশল সিপিবি