Wednesday 16 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতা আটকাতে পারেনি জাকিয়া-জাভেদকে

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৫ অক্টোবর ২০২৪ ২২:০০

চট্টগ্রাম ব্যুরো: জন্মের পর থেকেই দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ জাকিয়া আফরিনের। হাঁটতে-চলতে কষ্ট হতো। পাঁচ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হলেও দৃষ্টির সীমাবদ্ধতার কারণে বইয়ের লেখা ভালো করে বুঝতে অসুবিধা হতো। সেই সীমাবদ্ধতাকে জয় করে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে জাকিয়া নিজেকে অদম্য প্রমাণ করেছে।

জাকিয়ার তবু ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি, কিশোর আবুল মনসুর জাভেদ তো জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন। তবে পড়ালেখায় তার অদম্য আগ্রহের কাছে পরাজিত হয়েছে সেই দৃষ্টিহীনতা। বিশেষায়িত স্কুলে পড়ালেখা চালিয়ে শ্রুতিলেখকের সহায়তা নিয়ে জাভেদও এইচএসসিতে কৃতকার্য হয়েছে সফলভাবেই। জিপিএ-৫ না পাওয়ায় কিছুটা আক্ষেপ থাকলেও ৪ দশমিক ৫০ জিপিএ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ জাভেদ সীমবাদ্ধতাকে জয় করার উদাহরণই স্থাপন করেছে।

বিজ্ঞাপন

এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের পর মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) জাকিয়া ও জাভেদের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এ প্রতিবেদকের। তারা দুজনেই জানালেন তাদের সংগ্রামমুখর জীবনের কথা। দীর্ঘ সংগ্রামের পর জীবনের সবচেয়ে বড় এই পাবলিক পরীক্ষায় সাফল্যের উচ্ছ্বাস যেন কথা বলছিল তাদের চোখেমুখে।

নগরীর চান্দগাঁও এলাকার হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে জাকিয়া আফরিন। ইংরেজি বিষয়ে জিপিএ-৫ না আসায় তার ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ হাতছাড়া হয়েছে, তা নিয়ে কিছুটা হতাশাও আছে।

জাকিয়াদের বাড়ি শেরপুর জেলার নকলা থানায়। বাবা জাহাঙ্গীর আলম ব্র্যাকে চাকরি করার সুবাদে জাকিয়াকে তিন বছর বয়সেই চট্টগ্রামে চলে আসতে হয়। জাহাঙ্গীর আলমের পোস্টিং ছিল রাঙ্গুনিয়ায়। ওই সময় স্থানীয় ফকিরাঘাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা জাকিয়ার। এরপর পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ রাউজানের নোয়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। চোখে ঝাপসা দেখার কারণে স্কুলের শিক্ষকরা আলাদাভাবেই যত্ন নিতেন তার।

বিজ্ঞাপন

পরে রাঙ্গুনিয়ার পশ্চিম শিলক বেদুরা আলম উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা শেষ করে নগরীর হামজারবাগের রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে মাধ্যমিক সম্পন্ন হয় জাকিয়ার।

সারাবাংলার সঙ্গে আলাপচারিতায় দৃষ্টিশক্তির হ্রস্বতা নিয়ে কঠোর সংগ্রামের কথা তুলে ধরল জাকিয়া, ‘ছোটবেলায় আম্মু সব মুখে মুখে বলে শিখিয়েছেন। স্কুলে গেলেও শিক্ষকরা বোর্ডে কী লিখতেন, দেখতে পেতাম না। সহপাঠী ও শিক্ষকরা পরে বুঝিয়ে দিতেন। চোখে চশমা ব্যবহার করলেও বইয়ের অক্ষর দেখতে পেতাম না। সব ঝাপসা দেখতাম। অষ্টম শ্রেণির পর শ্রুতিলেখকের সাহায্য নিয়ে আমাকে পরীক্ষার টেবিলে বসতে হয়েছে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমি পড়ালেখা বন্ধ করিনি। আমার মা-বাবা, শিক্ষক সবাই আমার পাশে ছিলেন বলেই আজ আমি এতদূর আসতে পেরেছি।’

মায়ের সঙ্গে জাকিয়া। পরীক্ষার ফলে খুশি দুজনেই। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন জাকিয়ার, ‘আমি ইংরেজিতে ভালো। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেলেও ইংরেজিতে পাইনি। এ জন্য গোল্ডেন জিপিএ-৫ হাতছাড়া হয়ে গেল। তবু আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগেই পড়তে চাই। এরপর শিক্ষকতা পেশায় যেতে চাই।’

তিন বোনের মধ্যে জাকিয়া সবার বড়। মেজো বোন সাদিয়া আফরিন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সবার ছোট রাফিয়া জান্নাত শারিরীক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, স্থানীয় একটি কেজি স্কুলে প্লে গ্রুপে পড়ছে। তাকে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যেতে হয় মা ফেরদৌসী বেগমকে। তিন মেয়েকেই নিয়ে তার সংসার।

শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও সন্তানকে তিল তিল করে উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছেন ফেরদৌসী বেগম। জাকিয়ার এইচএসসি পরীক্ষার ফল তার পরিশ্রমেরও স্বীকৃতি যেন। সন্তানের এ অর্জন তার কাছে ধন-দৌলতের চেয়েও বেশি দামি।

ফেরদৌসী বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘জম্ম থেকেই তার দৃষ্টিশক্তি কম ছিল। মনে করেছিলাম বড় হলে ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু পাঁচ বছর বয়সে যখন তাকে স্কুলে ভর্তি করি, তখন থেকেই সে বইয়ের অক্ষর বুঝতে পারত না। বোর্ডে লেখা দেখত না। এরপর ডাক্তার তাকে চশমা দিলেও তেমন পরিবর্তন হয়নি। আমার মেজো মেয়ের চেয়েও তার মেধা বেশি। কিন্তু চোখে ভালোভাবে দেখতে না পারায় সে পরীক্ষার খাতায় লিখতে পারত না। তাই কম নম্বর পেত। পরে তার জন্য শ্রুতিলেখকের অনুমতি নিই। আমার মেজো মেয়েই এইচএসসি পরীক্ষায় তার শ্রুতিলেখক ছিল।’

জাকিয়ার বাবা জাহাঙ্গীর আলম মেয়ের এ সফলতা বিশ্বাসই করতে পারেননি শুরুতে। ফেরদৌসী বেগম বলেন, ‘পরীক্ষার ফলাফল দেবে শুনে (সোমবার) রাত থেকেই আমার মধ্যে টেনশন কাজ করছিল। আমার দুই ভাইকে ওর রোল আর রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে রেখেছিলাম। পরে সবাই যখন বলল সে আসলেই জিপিএ-৫ পেয়েছে, তখন তার বাবাকে কল দিয়ে জানালাম। সে তো এটা বিশ্বাসই করতে চায় না। সে বলে এটা আবার চেক করতে। পরে আবার চেক করে তাকে জানাই। তারপর সে বিশ্বাস করে।’

দৃষ্টিশক্তিতে জাকিয়ার চেয়েও পিছিয়ে কিশোর আবুল মনসুর জাভেদ। চোখে আলো নেই তার জন্ম থেকেই। তবুও জ্ঞানের আলোয় নিজেকে উজ্জ্বল করেছে কঠোর অধ্যাবসায়ে।

শ্রবণ প্রতিবন্ধী বাবা আবদুস সলিমের হাত ধরে নগরীর মুরাদপুরে দৃষ্টিহীনদের বিশেষায়িত স্কুলে পড়ালেখা শুরু জাভেদের। তাদের বাড়ি পটিয়ার ডেঙ্গাপাড়া এলাকায়। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে জাভেদ তৃতীয়। কৃষিকাজ করেই আবদুস সলিম তার পাঁচ ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন। মেজো ছেলে ইসলামী ব্যাংকের টাঙ্গাইল শাখায় কর্মরত।

নগরীর হামজারবাগের রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে ৪ দশমিক ৩৯ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল জাভেদ। এবার হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজ থেকে জিপিএ ৪ দশমিক ৫০ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। জিপিএ-৫ না পাওয়ায় অসন্তুষ্টি ও আক্ষেপ থাকলেও একেবারে হতাশ নয়।

জাভেদ সারাবাংলাকে বলল, ‘আমার যখন এসএসসি পরীক্ষা চলছিল, খুব অসুস্থ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। বিশেষ অনুরোধে আমি মেডিকেল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। যত কষ্টই হোক, পড়ালেখা ছাড়িনি। এইচএসসি পরীক্ষার সময় আমার কেন্দ্র শহরে ছিল। আমি বাড়িতে ছিলাম। প্রচুর বৃষ্টির মধ্যে বাবা আমাকে হাত ধরে নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিত। আবার নিয়ে আসত।’

‘আমার আজ এ সফলতার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান কারও থাকলে তিনি আমার বাবা। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলের আবদুস সামাদ স্যারের অবদানও অনেক। তিনি না থাকলে হয়তো আমি আজ এখানে আসতেই পারতাম না,’— বাবা ও শিক্ষকের কথা বলতে বলতে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধায় নুয়ে আসছিল জাভেদের মাথা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার লক্ষ্য এখন জাভেদের। তার ভাষায়, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে পড়তে চাই। পড়ালেখা শেষে আমি উদ্যেক্তা হতে চাই।’

সারাবাংলা/আইসি/টিআর

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

দক্ষিণ আফ্রিকা দল এখন বাংলাদেশে
১৬ অক্টোবর ২০২৪ ১৩:০৪

সম্পর্কিত খবর