ড. কামাল ‘অচল’, গুরুত্ব হারিয়েছে গণফোরামও
১৮ অক্টোবর ২০২৪ ১১:২৯
ঢাকা: জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বারবার আলোচনায় এসেছেন বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, আলোচনায় এসেছে তার দল গণফোরাম। নিজেদের ভোটব্যাংক শক্তিশালী না হলেও অন্যান্য দলের সঙ্গে জোট বেঁধে ভূমিকা রেখেছেন ড. কামাল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাকে সামনে রেখেই ভোটের মাঠে জোট করেছিল বিএনপিও।
সেই ড. কামাল হোসেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। ৮৭ বছর বয়সী ড. কামাল বলতে গেলে শারীরিকভাবে চলচ্ছক্তিহীন। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি ও তার দল গণফোরাম নেই আলোচনায়। দলের নেতাকর্মীরাই বলছেন, ড. কামাল হোসেনের শারিরীকভাবে অচল হয়ে পড়ার প্রভাব রয়েছে তার দলের গুরুত্ব হারানোর ওপরও।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক-সংলাপ করে। প্রথম দফায় গত ৩১ আগস্ট যেসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হয় তার মধ্যে ছিল ড. কামাল হোসেনের গণফোরামও। বৈঠকে সংবিধানে বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাব জানানো হয় গণফোরামের পক্ষ থেকে। এরপর সরকার একাধিকবার রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকলেও গণফোরাম আর ডাক পায়নি।
গণফোরামের নেতাকর্মীরা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলটি দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ড. কামাল উদ্যোগ নিয়েও সেই বিভক্তি ঠেকাতে পারেননি। প্রায় চার বছর পর গণফোরামের দুই অংশ মিলে গেলেও সাংগঠনিকভাবে দলটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নেতাকর্মীদের অনেকেই ভেবেছিলেন, গণফোরাম ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কার্যক্রমে তারাও এখন আর খুব বেশি আশাবাদী নন।
ড. কামাল হোসেনের শুরুর পরিচিতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী হিসেবে। বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামালকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভাতেও ছিলেন তিনি। তবে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হাল ধরলে আশির দশকের শেষের দিক থেকে তার সঙ্গে কামাল হোসেনের বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।
ওই সময়কার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় হওয়ার কারণ তুলে ধরে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন ড. কামাল। চিঠিতে নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে দলীয় কোন্দল ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসকে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। বলা হয়ে থাকে, ওই চিঠির পর ড. কামাল ও শেখ হাসিনার মধ্যেকার দূরত্ব অনেকটা প্রকাশ্যে চলে আসে।
ওই সময় আওয়ামী লীগে টিকে থাকা ড. কামালের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। দলীয় বিভিন্ন ফোরামে তিনি ক্রমাগত তোপের মুখে পড়তে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালের মার্চে ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যান। ওই সময় নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করে একটি রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরির চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন। গড়ে তোলেন ‘গণতান্ত্রিক ফোরাম’। তিন দিনের কাউন্সিল শেষে ১৯৯৩ সালের ২৯ আগস্ট তার নেতৃত্বে ‘গণফোরাম’ দল আত্মপ্রকাশ করে।
গণফোরামের ওই যাত্রা শুরুর অনুষ্ঠানে প্রয়াত ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, প্রয়াত ড. মোজাফফর আহমেদ, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। প্রতিষ্ঠাতার সময় থেকেই দলের সভাপতি ড. কামাল হোসেন। সে পদে ছিলেন প্রায় আড়াই দশক। এখন তিনি দলটির ইমেরিটাস সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
নব্বই দশকের শুরুতে প্রতিষ্ঠার পর থেকে গণফোরাম জাতীয় সব নির্বাচনেই অংশ নিয়েছে। তবে কোনো নির্বাচনেই দলটি সুবিধা করতে পারেনি। সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যখন দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে, ওই সময় ড. কামালকে সামনে রেখে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো গড়ে তোলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এই জোটের ব্যানারেই বিরোধী দলগুলো ভোটে অংশ নেয়। বিএনপির মতো বড় দল সঙ্গী হলেও এবারও ভোটে সুবিধা করতে পারেনি ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জোট। ওই নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ছয়টি ও গণফোরাম মাত্র দুটি আসনে জয় পায়।
ওই নির্বাচনের পরপরই ২০১৯ সালের শেষের দিকে গণফোরাম বিভক্ত হয়ে পড়ে। সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা মোহসীন মন্টুর নেতৃত্বে দলের নেতাকর্মীদের একাংশ আলাদা হয়ে যায়। আরেক অংশের নেতৃত্বে তখন চলে আসেন রেজা কিবরিয়া। দুই অংশের আলাদা আলাদা কাউন্সিলও হয়। ড. কামাল হোসেন উদ্যোগ নিয়েও বিভক্তি দূর করতে পারেননি।
প্রায় সাড়ে চার বছর পর গত ২৯ আগষ্ট দলের প্রতিষ্ঠাবর্ষিকীতে দুই অংশে বিভক্ত গণফোরাম ঐক্যবদ্ধ হয়। দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে আগামী ৩০ নভেম্বর জাতীয় কাউন্সল আহ্বান করা হয়েছে। ওই কাউন্সিল থেকে গণফোরামের জন্য নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে।
নেতাকর্মীরা বলছেন, জেলা-উপজেলা তো দূরের কথা, বিভাগীয় পর্যায়েও গণফোরামের সংগঠনিক অবস্থান শক্তিশালী নয়। দেশের ৫০টি জেলায় কমিটি থাকলেও তাদের সাংগঠনিক তেমন কোনো ভূমিকা নেই। দলের কার্যক্রম কেন্দ্রের মধ্যেই অনেকটা সীমাবদ্ধ।
বিভক্ত গণফোরাম গত প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর কাউন্সিল আয়োজনসহ সাংগঠনিক গতি বাড়ানে ১০ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। ওই কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে ডা. মিজানুর রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণফোরামের অবস্থান নিয়ে জানতে চাইলে ডা. মিজানুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের কাছে গণফোরামের গুরুত্ব কমেছে, এ কথাটি ঠিক নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ৩১ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে গণফোরামের পক্ষ থেকে ২০ দফা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’
এরপর সরকার একাধিকবার রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকলেও গণফোরামকে আর ডাকেনি। ডা. মিজানুর বলেন, ‘সরকার দ্বিতীয় দফায় গণফোরামকে সংলাপে ডাকেনি, সেটি ঠিক। কিন্তু ভবিষ্যতে গণফোরামকে আবার সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে আমরা আশা করি।’
ড. কামাল হোসেনের শারীরিক অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে ডা. মিজানুর বলেন, ‘ড. কামাল হোসেন স্যার অসুস্থ বা অচল নয়। তবে তিনি হুইল চেয়ারে করে চলাফেরা করেন। মতিঝিল চেম্বারেও যান। তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।’
১০ সদস্যের ওই কমিটির সদস্য আ্যডভোকেট জগলুল আফ্রিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ড. কামাল হোসেন স্যার অচল নয়। বলতে পারেন, হাঁটার সক্ষমতা নেই। তার নেতৃত্বেই গণফোরাম ঐক্যবদ্ধ।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর