সরকার পথ হারাক— চায় না গণতন্ত্র মঞ্চ
১৯ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:৪৪
ঢাকা: ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আড়াই মাস হলো দেশ পরিচালনা করছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলছেন, এই সময়ের মধ্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি, নিয়ন্ত্রণে আসেনি দ্রব্যমূল্যও। এ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার পথ হারাতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নেতারা।
মঞ্চের নেতারা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতার মনোভাব দেখা দিয়েছে। উপদেষ্টাদের মধ্যেও সমন্বয়হীনতা কাজ করছে বলে মনে করছেন তারা। বলছেন, এ পরিস্থিতিতে সরকারকে দ্রুতেই সমন্বয়হীনতা কাটিয়ে উঠে দ্রুত গতিতে সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে হবে। যাত্রা করতে হবে সুষ্ঠু ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে। এই সরকার পথ হারাক— এমনটি তাদের কাম্য নয়।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন— এই ছয়টি রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক জোট গণতন্ত্র মঞ্চ। সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের গণ অধিকার পরিষদ এই জোটের সঙ্গে থাকলেও পরে বেরিয়ে যায়।
জোটের নেতারা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অননতি, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ সব ক্ষেত্রে দলীয়করণ ও ভোটাধিকার হরণের মতো নানা কারণে আওয়ামী লীগ সরকার জনসমর্থন হারিয়েছিলেন। সে কারণেই ছাত্রদের আন্দোলনে একাত্ম হয়েছিল দেশের মানুষ। আওয়ামী লীগকে হটিয়ে এসব অপশাসন থেকে মুক্তিই ছিল মানুষের রাজপথে নেমে আসার অন্যতম কারণ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দুই মাসের কার্যক্রমও সন্তোষজনক নয়।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরেন জোট নেতারা। সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের এক বাসায় ঢুকে ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি সোনার অলংকার লুট, দীপ্ত টিভির সাংবাদিককে পিটিয়ে হত্যা, তাঁতীবজার পূজা মণ্ডপের পাশে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের মতো ঘটনা নিয়ে তারা গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন। বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকলে এসব ঘটনা ঘটত না।
সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই পুলিশ ও প্রশাসনকে জনবান্ধব করে তোলা, অর্থনীতিতে গতি ফেরানো, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানানো হচ্ছে। গুরুত্ব দিয়ে বলা হচ্ছে সংস্কার প্রক্রিয়ার কথাও, যেখানে এরই মধ্যে ছয় খাতের সংস্কারে পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠন করে দেওয়া হয়েছে। আরও চারটি কমিশন গঠনের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। সরকারের প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস বাস্তবে কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের।
এসব বিষয় নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি সাবেক ঢাকসু ভিপি মাহমুদর রহমান মান্না সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। তাদের কাছে জনগনের প্রত্যাশা অনেক। প্রথমত, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, দ্বিতীয়ত, জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব কাজে সরকারের পদক্ষেপ খুবই ধীরগতির। সরকারের কার্যক্রমে জনগণও হতাশ হয়ে পড়ছে।’
একই ধরনের অভিমত জানিয়ে বিপ্লবী ওয়াকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল হক বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে জনগণ স্বস্তিতে নেই। সেনা বাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে ডাকাতির ঘটনা আরও উদ্বগ ছড়িয়েছে। যে প্রত্যাশা নিয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন দেশের মানুষ ঘটিয়েছে, সেই প্রত্যাশা সরকার পূরণ করতে পারছে না। সরকারকে আরও দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা কাজ করতে পারে বলে মনে করছেন ভাসানী পরিষদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বাবলু। তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সরকারের উপদেষ্টাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সরকার যত দ্রুত এখান থেকে বের হয়ে আসতে পারে, ততই ভালো।’
চলমান পরিস্থিতিতে সরকারকে দ্রুত সংস্কার কার্যক্রম শেষ করে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দিকে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা। তারা বলছেন, বহু মানুষের জীবনের বিনিময়ে ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান ঘটেছে। দেশে গণতন্ত্রের চর্চা ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশায় মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। এই সরকার ব্যর্থ হলে দেশের গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা ফের ব্যাহত হবে। তাই এই সরকার ব্যর্থ হোক— এটি তারা কোনোভাবেই চান না।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক বলেন, ‘সরকারের হানিমুন পিরিয়ড শেষ। এখন সরকারের উচিৎ সংস্কারের কাজ দ্রুত শেষ করে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করতে পারলে সরকার সাধুবাদ পাবে। নইলে পরিস্থিতি মোকাবিলা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। তখন পথ হারাতে পারে সরকার, যা কাম্য নয়।’
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সংস্কারের জন্য যেসব কমিশন করা হয়েছে, তাদের কার্যক্রমে রাজনীতিবিদরা সন্তষ্ট নন। তারপরও সরকার দ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করে জাতীয় নির্বাচনের দিকে যাক, সেটাই প্রত্যাশা। সরকার পথ হারাক— তা আমরা চাই না।’
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী আ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। সরকারের কাছে মানুষের অনেক প্রত্যাশ্যা। অনেক ক্ষেত্রেই এই অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপে প্রশ্ন রয়েছে। সরকারের ব্যর্থতা আছে। তারপরও এই সরকারকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। নইলে গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা বাধাগ্রস্ত হবে।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর
অন্তর্বর্তী সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণতন্ত্র মঞ্চ গণসংহতি আন্দোলন জেএসডি নাগরিক ঐক্য বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ভাসানী পরিষদ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন