‘বাংলার মাটিতে শেখ হাসিনা-আ.লীগের রাজনীতি চলবে না’
২৬ অক্টোবর ২০২৪ ২০:৫৫ | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৪ ২০:৪৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগের রাজনীতি বাংলার মাটিতে চলবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মুহাম্মাদ মামুনুল হক। বিএনপি-জামায়াতসহ আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে এই মুহূর্তে দ্বন্দ্বে না জড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
শনিবার (২৬ অক্টোবর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর লালদিঘী ময়দানে দলটির পক্ষ থেকে আয়োজিত গণসমাবেশে মুহাম্মাদ মামুনুল হক এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। শাপলা চত্বরে হেফাজতের আন্দোলন ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গণহত্যার বিচার দাবি এবং পার্বত্য অঞ্চলসহ সারাদেশে নৈরাজ্যবাদ প্রতিরোধে এ গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মামুনুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে ক্ষমতার মসনদ ত্যাগ করার অনেক উদাহরণ আছে। এরশাদ সাহেব তো ক্ষমতার মসনদ ত্যাগ করে তার দলের নেতাকর্মীদের এতিম করে পালিয়ে যাননি। ২০০৬ সালে বেগম খালেদা জিয়াও তো ক্ষমতার মসনদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি কি পালিয়ে গিয়েছিলেন? তিনি অনেক রোগব্যাধিতে ভুগে, কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন। কিন্তু নিজের দলের নেতাকর্মীদের ফেলে পালিয়ে যাননি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলেন- আপনার নেত্রী কামটা করল কী?’
তিনি বলেন, ‘তিনি ৫ আগস্ট দুপুরে ১২ পদের আইটেম দিয়ে লাঞ্চের আয়োজন করেছিলেন, গণভবনে যারা গিয়েছিলেন তাদের কাছে শুনেছি। তার পর বুঝলেন এদেশে তার আর লাঞ্চ করা হবে না, প্রভুর দেশে গিয়ে করতে হবে। দুই ছেলে-মেয়ে ও লাখ লাখ কোটি টাকা আগেই তিনি বিদেশে পাচার করেছেন। এর পর বাকি যা ছিল, সেগুলো ১৬টা লাগেজে ভরে, একটা বোন ছিল, সেটাকে বগলদাবা করে একটা হেলিকপ্টারে করে আকাশপথে যাদের স্বার্থে ১৫ বছর বাংলাদেশটাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খার করেছেন, তাদের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। এর পরও আওয়ামী লীগের লোকজন এ হাসিনার নাম মুখে নেয় ?
এ সময় সমবেত নেতাকর্মীরা ‘ছি! ছি! হাসিনা– লজ্জায় বাঁচি না’ স্লোগানে স্লোগানে পুরো ময়দান মুখর করে তোলেন। মামুনুল হক বলেন, ‘৫ আগস্টের কয়েকদিন আগে তিনি বলেছিলেন, শেখ হাসিনা না কি পালায় না। এ বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে গৌরগোবিন্দ একবার শাহজালালের দাবড়ানি খেয়ে পালিয়েছিল। আর শত, শত বছর পরে ২০২৪ সালে বাংলার তৌহিদি জনতার দাবড়ানি খেয়ে শেখ হাসিনা বাংলার মাটি ছেড়ে পালিয়ে গেছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট ভাষায় বার্তা দিতে চাই, যতগুলো গণহত্যা শেখ হাসিনা করেছে, ২০০৯ সালে, ২০১৩ সালে, ২০২১ সালে, ২০২৪ সালে, ততগুলো গণহত্যার জন্য শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের বিচার করতে হবে। আমরা লক্ষ্য করেছি, এরই মধ্যে শেখ হাসিনা বিরুদ্ধে শতাধিক হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। আবার আদালত থেকে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এই খুনি হাসিনাকে ধরে এনে আইনের হাতে সোপর্দ্দ করতে হবে। তার বিচার করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে নবীপ্রেমী তৌহিদি জনতাকে গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ অনেক জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, অনেক শাহাদাতের রক্ত পেরিয়ে আজ বাংলাদেশের আকাশে স্বাধীনতার সূর্য উঠেছে। যেকোনো মূল্যে এ স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করা আরও কঠিন। বিজয় অর্জন করা যত কঠিন, বিজয়ের সুফল ঘরে তোলা তার চেয়েও কঠিন।’
শেখ মুজিবুর রহমান ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ধ্বংস করেছিলেন উল্লেখ করে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব বলেন, ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে। ইনশাল্লাহ বলে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সবকিছু সোপর্দ্দ করে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল, এদেশের মাটিতে কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন তৈরি করা হবে না। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, স্বাধীনতার বিজয় অর্জনের মাত্র কয়েকমাস পর বাংলাদেশের মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখে, সেই স্বাধীনতার অর্জনকে ছিনতাই করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘একটি ভিনদেশি সংবিধানের মূলনীতিগুলোকে কলমের খোঁচায়, তাদের প্রেসক্রিপশনে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা ছিল বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের অভিপ্রায়ের বিরোধী। আর এভাবেই ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিনতাই হয়ে যায়। ১৯৭২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাহাত্তরের চেতনাকে একাত্তরের চেতনা বলে মার্কেটিং করা হয়েছে। বাহাত্তরের চেতনার মাধ্যমে একাত্তরের চেতনাকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশ একাত্তরের চেতনাকে রক্ষা করবে, বাহাত্তরের চেতনার ঠাঁই বাংলার মাটিতে হবে না।’
মামুনুল হক আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনা বাহাত্তরের চেতনার ওপর নির্ভর করে রাজনীতি করেছেন। তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানও একাত্তরের চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে এদেশের মানুষের ভোটাধিকার বুটের চাপায় পিষ্ঠ করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিলেন। তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ৩০ হাজার মায়ের কোল খালি করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীন ভূখণ্ডে সর্বপ্রথম ক্রসফায়ারের সংস্কৃতি চালু করেছেন। সিরাজ শিকদারের মতো দেশপ্রেমিক মানুষকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে বাংলাদেশকে বিচারহীনতার বর্বর যুগে নিয়ে গিয়েছিলেন।’
‘এ সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপ্লব হয়েছে, অভ্যুত্থান হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব সপরিবারে নিহত হয়েছেন। সেই নিহত হবার ঘটনায়, যে মানুষটিকে ১৯৭১ সালে বাংলার মানুষ অবিসংবাদিত নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছিল, সেই নেতার মৃত্যুর পর সেদিন বাংলাদেশের কোনো মিষ্টির দোকানে মিষ্টি খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
প্রতিশোধ আর বিভাজনই ছিল শেখ হাসিনার রাজনীতির দর্শন- এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এদেশের মানুষের ওপর, জাতির ওপর, এমনকি তার দল আওয়ামী লীগের ওপর। এরপর তিনি ঘোষণা করলেন, যারা তার বাবাকে হত্যা করেছে, তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে, তিনি প্রতিশোধ নেবেন। শুরু হলো শেখ হাসিনার প্রতিশোধের রাজনীতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, দুটি দর্শনের ওপর ভিত্তি করে শেখ হাসিনা রাজনীতি করেছেন। প্রথম দর্শন ছিল প্রতিশোধের রাজনীতি, দ্বিতীয় দর্শন ছিল বিভাজন। তিনি এদেশের মানুষের ওপর, এ জাতির ওপর প্রতিশোধ নিয়েছেন।’
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের ওপরও প্রতিশোধ নিয়েছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা বলেছেন- এত বড় দল, এত নেতাকর্মী, ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে শেখ মুজিবের লাশ দিনের পর রাত, রাতের পর দিন পড়ে থাকল, একটা মানুষও তো এগিয়ে আসল না। বরং সেদিন তার দল আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবকে খুন করে ক্ষমতার মসনদ দখল করেছিল, আওয়ামী লীগই। সেদিন থেকেই তিনি পণ করেছিলেন আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার। আর ২০২৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগকে পরিপূর্ণ বাঁশটা দিয়ে এদেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের লোকজন বিবেক দিয়ে চিন্তা করুন, আপনারা সেই শেখ হাসিনার জন্য মায়াকান্না করেন, আপনাদের নিজেদের লজ্জা পাওয়া উচিত।’
মামুনুল হক বলেন, ‘শেখ হাসিনার প্রতিশোধের রাজনীতি বাংলার মাটিতে চলবে না, বিভাজনের রাজনীতি বাংলার মাটিতে চলবে না, আওয়ামী লীগের রাজনীতিও বাংলার মাটিতে চলবে না। আমি অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানাই, সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জোর দাবি জানাতে চাই, ছাত্রলীগের চেয়েও অনেক বেশি সন্ত্রাস করেছে যুবলীগ, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সন্ত্রাস করেছে আওয়ামী লীগ। যে কারণে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হয়েছে, একই কারণে যুবলীগ নিষিদ্ধ হতে হবে, হাতুড়ি লীগ নিষিদ্ধ হতে হবে, হেলমেট লীগ নিষিদ্ধ হতে হবে। শাহজালালের বাংলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।’
বিএনপি, জামায়াত ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, এনডিপি, এলডিপি, গণ অধিকার পরিষদ, গণতন্ত্র মঞ্চের নাম উল্লেখ করে মামুনুল বলেন, ‘সকলকে বলতে চাই, এখনই পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার সময় আসেনি। ইস্পাত কঠিন ঐক্য ধরে রেখে পতিত স্বৈরাচারদের পুনর্বাসিত হওয়ার রাস্তা ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমরা আরও কোনো অস্থিতিশীলতা দেখতে চাই না। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি, দেশপ্রেমিক জনতা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে, তাহলে বাংলার মাটিকে আর কোনোদিন কোন সাম্রাজ্যবাদ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে পারবে না।’
খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমীর আলী উসমানের সভাপতিত্বে গণসমাবেশে দলটির যুগ্ম মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমেদ, আতাউল্লাহ আমীন, তোফাজ্জল হোসাইন মিয়াজীসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা বক্তব্য দেন।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম