সরকারের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে রাজনৈতিক দলগুলোর
৩১ অক্টোবর ২০২৪ ২৩:১৯
ঢাকা: ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেয় অধ্যাপক মুহাম্মাদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শেখ হাসিনার শাসনামলে নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার রাজনৈতিক দলগুলো এ সময় অনেকটাই কাছাকাছি চলে আসে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও শুরু থেকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে দলগুলো। তবে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আড়াই মাসের মাথায় সে চিত্র বদলে যেতে শুরু করেছে।
পরিস্থিতি বলছে, বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, জাতীয় নির্বাচন আয়োজন ও রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কারের মতো ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ বাড়ছে, কমছে নৈকট্য।
বিভিন্ন দলের নেতারা বলছেন, জাতীয় ও জনস্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে কিংবা সাংবিধানিক সংকট তৈরি হতে পারে— এমন ইস্যুতে সরকারের অবস্থানের সঙ্গে একমত পারছেন না তারা। তৈরি হচ্ছে মতানৈক্য। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে শুরু থেকেই যে ‘সুসর্ম্পক’ ছিল, তাও গড়াচ্ছে অবনতির দিকে।
গত কয়েক দিনে সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য তৈরির বড় ইস্যু ছিল রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণ। সাংবিধানিক সংকট তৈরি হতে পারে— এমন আশঙ্কা থেকে বিএনপি, সিপিবি, জাসদ, বাসদ নাগরিক ঐক্য ও গণঅধিকার পরিষদ রাষ্ট্রপতি পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ বা অপসারণের পক্ষে হাঁটতে চাইছে না। গত কয়েকদিনে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এই ইস্যুতে আলোচনা করছে ছাত্রদের পৃথক দুটি প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।
এদিকে জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের অবস্থান এক সমতলে নয়। সরকার শুরু থেকেই বলে আসছে, গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কারই তাদের অগ্রাধিকার। সংস্কারকাজ শেষে হবে নির্বাচন। সংস্কারের পক্ষে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোও। তবে এ ক্ষেত্রে অবস্থানগত পার্থক্য রয়েছে দলগুলোর মধ্যে। অনেক দলেরই অভিমত, মৌলিক দুয়েকটি খাতে সংস্কার করে সরকারের উচিত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। রাজনৈতিক সরকার এসে বাকি সংস্কারকাজ শেষ করবে।
এদিকে বাজার পরিস্থিতির ওপর সরকার এখনো খুব একটা নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে পারেনি— এটি অনেকটাই দৃশ্যমান। সারা দেশে থানাগুলো সচল হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের অভিযোগ, সরকার এসব ইস্যুতে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে এক করতে পারছে না।
সরকারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরির কথা স্বীকার করেননি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্কের অবনতি কিংবা দূরত্ব বেড়েছে বলে আমি মনে করি না। এমন কথা আমরা কোথাও বলিনি।’
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণে ইস্যু নিয়ে বিএনপির অবস্থান জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে সেটি সাংবিধানিক। রাষ্ট্রপতি আমাদের মনোনীত কেউ নন। তিনি আমাদের পছন্দেরও নন। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা বা ছাত্ররা যা চাইছেন, তা অসাংবিধানিক। চাওয়া যেটাই হোক, অসংবিধানিকভাবে চাইলে হবে?’
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা বলিনি যে রাষ্ট্রপতিকে বদলানো যাবে না। কিন্তু তাকে বদলাতে গিয়ে এমন কিছুও করা ঠিক হবে না যা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট তৈরি করবে। সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়, এমন কাজ করা যাবে না।’
ছাত্রদের কর্মকাণ্ডের কারণেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মো. শাহ আলম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্ররা নতুন নতুন এজেন্ডা নিয়ে হাজির হচ্ছে। ৭ মার্চ নিয়ে একটি বিতর্ক তৈরি করেছে। বাহাত্তরের সংবিধান সামনে এনে বিতর্ক তৈরি করেছে। ছাত্রদের নতুন নতুন এজেন্ডার কারণে সরকার বিতর্কের মধ্যে পড়ছে। এসব কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও সরকারে সুসম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা দূরত্ব বাড়ছে।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অনিয়ন্ত্রিত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা মনে করছেন সিপিবি সভাপতি শাহ আলম। তার অভিমত, এর জন্য রাজনৈতিক দল শুধু নয়, জনগণের সঙ্গেও সরকারের দূরত্ব বাড়ছে। এতে উলটো লাভবান হচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারই। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের তাগিদ দেন তিনি।
শাহ আলম বলেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারের দ্রুত কাজ করা উচিত বলে মনে করি। স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য জনগণ জীবন দিয়েছে। জনগণ গত ১৫ বছর তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। নিজ পছন্দে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেনি। সেই সরকারের বিদায়ে এখন নির্বাচন সামনে রেখে দ্রুত কাজ করাটাই হবে জনগণের আন্দোলনের সফলতা।’
সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্কের অবনতিকে স্বাভাবিক অভিহিত করে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সারাবাংলাকে বলেন, সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি বা উন্নতি মুখ্য কোনো বিষয় নয়। আমরা সরকারকে সমর্থন করেছি। তবে সে সমর্থন সবসময়ের জন্য গ্যারান্টেডও নয়। আমাদের যখনই মনে হবে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত বা কার্যক্রম সংবিধানবিরোধী বা দেশ ও জাতীর স্বার্থের বাইরে যাচ্ছে, তখনই প্রশ্ন করা হবে। প্রশ্নগুলো আমরা দ্বিধাহীনভাবে করছি এবং করব। এ জন্য আমাদের ভুল বুঝলে কিছু করার থাকবে না।’
সম্পর্ক যেমনই হোক, সরকারের সাফল্যই কামনা করছেন মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ছাড়াও রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে সরকার জনগণ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। গত দুয়েক দিনে দ্রব্যমূল্য সামান্য কমলেও জনগণের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এ সরকার ব্যর্থ হোক, তা আমরা চাই না। কিন্তু ব্যর্থতার দিকে গেলে তা আমরা বলব না? অবশ্যই বলব।’
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ বা আলাপ-আলোচনা করে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মনে করেছন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বশেষ সংলাপের পর সরকার ও দলগুলোর মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব কিছুটা হলেও কমেছে বলেও মনে করেন তিনি।
সাইফুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার দূরত্ব রেখে চলছিল। সংলাপের মধ্য দিয়ে সে দূরত্ব অনেকটা কেটেছে বলে আমি মনে করি। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে পথ চলা। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। তা না হলে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে।’
দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সম্পর্কে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির এই নেতা বলেন, ‘সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তা বলব না। আমি বলব, সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে এবং সরকারের কার্যক্রমের মধ্যে ঘাটতি রয়েছে। স্বৈরাচার সরকারের পতনের পরে জনগণ যে ফলাফল দেখতে চেয়েছিল তা দেখতে পাচ্ছে না। এ কারণে জনগণ অস্বস্তিতে রয়েছে।’
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব বেড়েছে, এমনটি হয়তো না। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে। সরকারের উচিত যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে এসব নিয়ন্ত্রণ করা।’
অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর সমালোচনা করে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন স্বপন বলেন, ‘সরকারের কার্যক্রম গতিহীন। সরকার কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিকে তাকালে মনে হবে, পুলিশবিহীন রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আধুনিক জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে পারেননি। পুলিশ প্রশাসনে এখনো বিগত স্বৈরাচারের লোকজন বহাল তবিয়তে রয়েছে। জনপ্রশাসনেও একই দুর্দশা।’
শহিদ উদ্দিন স্বপন আরও বলেন, ‘সরকারের প্রতি আমাদের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। তবে জনগণের যে প্রত্যাশা, সরকার তা পূরণ করতে পারেনি। সরকারের সঙ্গে আমাদেরও একাধিকবার কথা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে। সরকার আশ্বাস দিয়েছে, সংস্কারের জন্য দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখছি না।’
এ পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প দেখছেন না গণঅধিকার পরিষদের রাশেদ খান। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘হুটহাট করে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দিলে দেশের জন্য ক্ষতি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা যেতে পারে। এসব জটিলতা নিরসনে জাতীয় ঐক্যমত ও সংহতির বিকল্প নেই।’
রাশেদ খান আরও বলেন, ‘অনেক নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটছে। এসব রাজনৈতিক দল ও শক্তির মধ্যে চাওয়া-পাওয়ার ভিন্নতা রয়েছে। ভিন্নমতসহ বিভিন্ন কারণে সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে বা সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। তাছাড়া সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ হয়েছে ইস্যুভিত্তিক। সার্বিক বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ হয়নি। সার্বিক একটি সংলাপ হলে এই দূরত্ব কেটে যেতে পারে।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর
অন্তর্বর্তী সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতি অপসারণ