কমলা নাকি ট্রাম্প— যুদ্ধ থামাবেন কে?
২ নভেম্বর ২০২৪ ১০:০০
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ সফরে গিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। অপ্রত্যাশিত সেই সফরে তিনি বৈঠক করেছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে। সংহতি জানিয়েছিলেন তার প্রতি। জেলেনস্কির সঙ্গে যখন তিনি দেখা করতে যাচ্ছিলেন, ওই সময় কিয়েভের আকাশে-বাতাসে সাইরেনের শব্দ। সে দিনের স্মৃতিচারণ করে বাইডেন বলেন, ‘আগেও মনে হয়েছে, কিন্তু তখনকার মতো এত এত প্রকটভাবে কখনো মনে হয়নি যে আমেরিকাই এই বিশ্বের কাছে এক আলোকবর্তিকার মতো।’
এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় দুই বছর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে জো বাইডেনের মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে। নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার মুখে দাঁড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। সামনের সপ্তাহেই নির্ধারণ হবে, পরবর্তী চার বছর যুক্তরাষ্ট্রকে সামলানোর দায়িত্বে কে থাকবেন। এই চার বছরে কি কমলা হ্যারিস তার দলের পূর্বসূরী জো বাইডেনেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন, যিনি বিশ্বাস করেন যে ‘এই অস্থির সময়ে আমেরিকার পিছু হঠার সুযোগ নেই’? নাকি আমেরিকানরা বেছে নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে, যিনি ‘বিশ্বায়ন নয়, আমেরিকানিজমে’ বিশ্বাসী?
বিশ্বব্যাপী সংঘাতময় এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কতটা, তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। এখন অনেক এলাকাতেই আঞ্চলিক শক্তিগুলো নিজেদের মতো করে পথ খুঁজছে, অনেক এলাকায় স্বৈরশাসকরা নিজেদের মতো করে জোট বাঁধছে। গাজা ও ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতিও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ওয়াশিংটনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছে। বৈশ্বিক রাজনীতি আর অর্থনীতিতে এমন যত পালাবদলই আসুক না কেন, এখন পর্যন্ত বাস্তবতা এটিই— অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিমত্তা এবং অসংখ্য জোটের অংশীদার হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
সামরিক শক্তি ও ন্যাটোভিত্তিক রাজনীতি
বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে ন্যাটো একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ইউক্রেনসহ ইউরোপর বিভিন্ন দেশের ন্যাটোতে যোগদানের আগ্রহ কিংবা ন্যাটোতে যোগ দিতে বিভিন্ন দেশকে রাশিয়ার নিরুৎসাহিত করার মতো সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ন্যাটোর গুরুত্বকেই স্পষ্ট করে।
৩২ দেশের এই সামরিক জোট ন্যাটোর অন্যতম অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। সামরিক খাতে খরচে স্বাভাবিকভাবেই দেশটি শীর্ষে রয়েছে। ন্যাটোতে বাকি ৩১টি দেশ সামরিক খাতে যে পরিমাণ খরচ করে, যুক্তরাষ্ট্র একাই খরচ করে তার দুই-তৃতীয়াংশ। অন্যদিকে সামরিক খাতে ব্যয়ের হিসাবে দ্বিতীয় থেকে একাদশ স্থান পর্যন্ত ১০টি দেশ মোট যে পরিমাণ খরচ করে, এই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের একার খরচ তার চেয়ে বেশি।
সামরিক খাতে খরচের মতোই ন্যাটোতে খরচ দেওয়ার বিষয়েও এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালে এ নিয়ে বিস্তর জল ঘোলা করেছেন। ন্যাটের সাবেক ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল রোজ গোটমোয়েলার বলেন, ‘যেসব উদ্বেগ আছে সেগুলোকে মনভোলানো কথা দিয়ে আড়াল করার কিছু নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিতে তার হুমকি এখনো সবার কানে বাজে।’ ফলে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তা নিয়ে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো জোটটি নিয়ে উদ্বেগে থাকবে, এটা স্বাভাবিক।
ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হলে। গোটমোয়েলার বলেন, ‘কমলা হ্যারিস জিতলে ন্যাটো ওয়াশিংটনে নিঃসন্দেহে ভালো অবস্থায় থাকবে। তিনি (কমলা) ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ করে ইউক্রেনে জয় অর্জনের জন্য প্রস্তুত।’
এখানে অবশ্য একটি ‘কিন্তু’ও রয়েছে। কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পেলেও সামনের সিনেটে রিপাবলিকানদের জয় পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ওয়াশিংটনকে দেশের বাইরে যুদ্ধে খরচ করার জন্য সিনেট থেকেও অনুমোদন পেতে হবে। রিপাবলিকানরা সিনেটে আধিপত্য ধরে রাখতে পারলে কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হলেও সিনট থেকে যুদ্ধের জন্য খরচের অনুমোদন পেতে বেগ পেতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের মধ্যে যুদ্ধের জন্য খরচ বরাদ্দে অনাগ্রহ বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্রকে হিসাবের বাইরে রেখেই কীভাবে যুদ্ধ চালানো যায়, সেদিকে মনোযোগী হতে হবে কিয়েভকে।
রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের কী প্রভাব পড়বে
বর্তমানের এই সময়ের বিশ্বকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সবচেয়ে অশান্ত বলে মনে করা হচ্ছে। সরাসরি যুদ্ধ চলছে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে, ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যে। ইরান-লেবাননও সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে ইসরায়েলের সঙ্গে। আফ্রিকার কয়েকটি দেশও রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল নেই। ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে মার্কিনিরা যাকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করুক, তাকেই বৈশ্বিক এই যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও সিইও কমফোর্ট এরো বলেন, শান্তি বা নিরাপত্তা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এখনো সবচেয়ে প্রভাবশালী। তবে সংঘর্ষ বা সংঘাত নিরসনে এর ক্ষমতা দিন দিন কমছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিন দিন যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে এবং যুদ্ধ থামানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কমফোর্ট এরো বলেন, ‘বড় বড় ক্ষমতাধর দেশগুলোর প্রত্যক্ষ সক্রিয়তায় এবং মাঝারি শক্তিধর দেশগুলোর উত্থানের কারণে রক্তক্ষয়ী সংঘাত ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।’
এরোর বক্তব্যের প্রমাণও সবার সামনে স্পষ্ট। ইউক্রেন যুদ্ধে যেমন বিভিন্ন দেশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়। অন্যদিকে সুদানেও সহিংসতা চলছে। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাপী শান্তির চেয়ে যুদ্ধেই বিনিয়োগ বেশি হচ্ছে। আমেরিকাও তাদের যুদ্ধবিরোধী নৈতিক অবস্থান অনেকটাই হারিয়েছে তার দ্বিচারিতার কারণে।
এরো বলেন, ‘এটা সবার সামনেই স্পষ্ট যে আমেরিকা এক ধরনের আচরণ করছে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়ে, আবার ঠিক বিপরীতমুখী আচরণ করছে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন নিয়ে। সুদানে যে যুদ্ধ চলছে, সেটি নৃশংসতার দিক থেকে কোনোভাবেই কম নয়। কিন্তু সেই যুদ্ধকে যেন তারা দ্বিতীয় সারির কোনো ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিই নেই।’
এ পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের ভূমিকা কেমন হবে, সে প্রসঙ্গে এরো বলেন, ‘কমলা হ্যারিস জিতলে বর্তমান বাইডেন প্রশাসনের যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট যেসব নীতি, তারই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। অন্যদিকে ট্রাম্প জিতলে ইসরায়েল আরও মুক্তভাবে গাজা বা অন্য দেশগুলোতে হামলা চালাতে পারবে। আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে উলটো কিয়েভকে অগ্রাহ্য করে মস্কোর সঙ্গেই ট্রাম্প চুক্তি করে ফেলতে পারেন।’
এবারের নির্বাচনের প্রচারে কমলা হ্যারিস মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ প্রসঙ্গে বারবারই বাইডেনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেছেন, ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ রয়েছে। তবে এর পাশাপাশি ফিলিস্তিনের ‘নিরীহ মানুষদের হত্যা বন্ধে’র আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে ট্রাম্প বলেছেন, এখন ‘মানুষ হত্যা বন্ধ করে শান্তি ফিরিয়ে আনা’র সময়। তবে তিনি এ-ও বলেছেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ‘যা খুশি তাই’ করতে পারেন। সৌদি আরবের একটি টিভি চ্যানেলে নিজেকে শান্তি আনয়নকারী দাবি করে ট্রাম্প বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে খুব শিগগিরই শান্তি নিয়ে আসব।’ আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কোন্নয়ন করতে ২০২০ সালের ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ও ফিরিয়ে আনবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতেও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি অনুরাগের কথা গোপন রাখেননি ট্রাম্প। খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান চান তিনি, তার জন্য মার্কিন সামরিক বা আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন হলে তিনি দেবেন। ট্রাম্প সাম্প্রতিক এক সমাবেশেও বলেন, ‘এখান (ইউক্রেন যুদ্ধ) থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।’
নির্বাচনি প্রচারে একেবারেই ভিন্ন কথা বলেছেন কমলা হ্যারিস। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াতে পেরে আমি গর্বিত। আমি ইউক্রেনকে সমর্থন অব্যাহত রাখব। ইউক্রেন যেন এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে আমি কাজ করে যাব।’
নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক কিংবা ট্রাম্প বা কমলা যাই বলুক না কেন, কমফোর্ট এরো বলছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি দিন দিন আরও অবনতির দিকেই যাবে।
[বিবিসির প্রধান আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি লিসে ডোসেটের প্রতিবেদন অবলম্বনে]
সারাবাংলা/টিআর
ইউক্রেন ইসরায়েল কমলা হ্যারিস গাজায় হামলা ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-২০২০ যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ