‘চাপহীন’ ক্যাম্পাসে কবে ফিরবে ডাকসু?
৩ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০০
ঢাকা: ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধসহ ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জন্মলগ্ন থেকে ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক বদলে ঢাবির অবদান অনস্বীকার্য। অথচ প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই ছাত্র সংসদ।
দীর্ঘ ২৮ বছর অচল থাকার পর ২০১৯ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে সচল হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও ১৮টি হল সংসদ। সেই ছাত্র সংসদের মেয়াদও শেষ হয়েছে ২০২০ সালে। করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও ক্যাম্পাস। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ২০২১ সালের ৫ অক্টোবর থেকে হল ও ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া হয়। এর পর তিন বছর পেরুলেও ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এমনকি জুলাই অভ্যুত্থানের পরেও কোনো খবর নেই ডাকসু নির্বাচনের।
কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের আগে ডাকসু নির্বাচন না দেওয়ার পেছনে দায় দেওয়া হতো আওয়ামী লীগ ও তার ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ চায়নি বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচন দিতে পারেনি। অথচ, ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রতিবছর ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা। ডাকসুর নির্বাচিত নেতারা বিশ্ববিদ্যালয় নীতি নির্ধারণী ফোরাম সিনেটের সদস্য হন। এই আনুষ্ঠানিক ফোরামে তারা শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলার সুযোগ পান। কিন্তু ডাকসু না থাকায় শিক্ষার্থীদের সে প্রতিনিধিত্ব নেই।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অন্য সব প্রতিষ্ঠানের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থাসহ সব কার্যক্রমে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা কীভাবে টিকে থাকবে তা নিয়ে নেই কোনো পদক্ষেপ। শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ছাত্র সংসদের অনুপস্থিতিতে ফের ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে।
ডাকসু নির্বাচনে ঢাবি শিক্ষার্থী আলতাফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে ভর্তি হই। তখন ডাকসু নির্বাচনের মৌসুম। ভর্তি হওয়ার পর সাধারণত ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গেস্টরুম বাধ্যতামূলক। কিন্তু নির্বাচনের মৌসুম হওয়ায় আমাদের গেস্টরুম করতে হয়নি। এভাবে প্রতিবছর যদি নির্বাচনের ধারাবাহিকতা থাকে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে যে স্বৈরাচারী হওয়ার ইচ্ছে জাগে তার অবসান ঘটবে।’
ঢাবি শিক্ষার্থী নাজিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ’ডাকসু নির্বাচন থাকলে শিক্ষার্থীদের অধিকার চর্চার সুযোগ থাকে। বিগত সময়ে ডাকসু ছিল না বলেই ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর এমন অমানবিক নির্যাতন ও নিপীড়ন করতে পেরেছে। তাই সেসব সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে চাইলে ডাকসু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।‘
জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে নেই কোনো রাজনৈতিক চাপ, নেই ছাত্রলীগের পেশীর জোর। এমনকি প্রশাসনেও নেই দলীয় প্রভাব। তাই শিক্ষার্থীরা ডাকসু নির্বাচনের দাবি করছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন ডাকসু নির্বাচন দিতে পারছে না?- তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে ঢাবি উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ড. সাইমা হক বিদিশা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব নিয়েছি দু’মাস হচ্ছে। এই সময়ে আমরা ধাপে ধাপে কাজ করছি। আর, ডাকসু নির্বাচন কোনো ছোটখাটো বিষয় না। এই বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করছি।’
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ঢাবি উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমেদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনের বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। এ বিষয়ে সব স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে বসব। তার পর কীভাবে ডাকসু নির্বাচন দিলে সুবিধা হয়- সেভাবে কাজ করব। এছাড়া, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আমরা একটি কমিটি গঠনের চেষ্টা করছি।‘
তিনি আরও বলেন, ’আমরা এ বিষয়ে সকল স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে বসব। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ডাকসুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। যত দ্রুত নির্বাচন দেওয়া যায় তা নিয়ে কাজ করব আমরা।‘
ডাকসু ও হল সংসদ নেই, তবে ফি আছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, ঢাবির বর্তমান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিবছর হল সংসদ ও ডাকসু বাবদ ১২০ টাকা করে নেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনুযায়ী তাদের কাছ থেকে ডাকসু ও হল সংসদ বাবদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের পরিমাণ ৪৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সে হিসাবে চার বছরে ডাকসু ও হল সংসদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়েছে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এখন ঢাবির শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন, ডাকসুর এই টাকা কোথায় কাজে লাগানো হচ্ছে?
এ নিয়ে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) সাইমা হক বিদিশা বলেন, ‘আমার হাতে কোনো এক্সেল শিট নাই এই মুহূর্তে। তবে আপনারা জানেন যে, আমাদের বাজেট স্বল্পতা আছে। তাই, ডাকসুর এই টাকা শিক্ষার্থীদের পেছনে খরচ করা হতে পারে। তবে টাকাটা ডাকসুর পেছনে খরচ করা গেলে ভালো হতো।‘
ডাকসু নিয়ে কী ভাবছে অন্যান্য ছাত্রসংগঠন
ডাকসু নিয়ে ঢাবি ছাত্র শিবিরের সভাপতি আবু সাদিক কায়েম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশ ও জাতি গঠনের জন্য ডাকসু দরকার। তাই, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডাকসুর তফসিল ঘোষণা করে- আমরা সেটাই চাই। এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ যেন ডায়ালগের আয়োজন করে। যেখানে অংশীজনদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে ও নির্বাচিতদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া পূরণের সুযোগ করে দেওয়া হয়।’
ছাত্রশিবির ডাকসুতে প্যানেল দিবে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্যানেলের জন্য আগে ডায়ালগে বসা দরকার। ২৪-এর অভ্যুত্থানকে সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া অনুযায়ী নতুন করে সংস্কারের মধ্যে দিয়ে ডাকসু নির্বাচন হোক।’
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাবি শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র সাহস সারাবাংলাকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ পুরো বাংলাদেশই যেন ট্রমাটাইজড হয়ে আছে। দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদের প্রভাবে পুলিশসহ প্রশাসনের সব কাঠামো প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ছাত্রলীগের রোষানলে পড়া ঢাবির অনেক শিক্ষার্থী নতুন করে হলে উঠছে। ছাত্রদলসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো অনেক বছর পরে মুক্তভাবে ক্যাম্পাসে সহাবস্থান করতে পারছে।’
তিনি বলেন, ‘এই অবস্থায় খুব দ্রুত বা খুব দেরিতে ডাকসু নির্বাচনের মানে হতে পারে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট করা। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা। যেখানে একটা গ্রহণযোগ্য সময়ে নির্বাচনের কথা বলা হবে। এতে সব ভয় ও ট্রমা কাটিয়ে উঠে শিক্ষার্থীরা সুন্দর মানসিকতা নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে ডাকসু নির্বাচনে ভোট দেবে।’
ডাকসু প্যানেল দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রশাসন ডাকসু নির্বাচনের একটা গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপ ঘোষণা করলেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল তাদের নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু করবে।’
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিতে প্রশাসনকে দ্রুত ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। এটি ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক প্লাটফর্ম। দীর্ঘ ২৮ বছর পর সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। সে নির্বাচন ছিল প্রহসনমূলক এবং প্রশাসন-ছাত্রলীগের স্বৈরতান্ত্রিক প্রভাব বলয়ের মধ্যে। আমরা চাই, সামনের ডাকসু নির্বাচন হবে গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায়। সেই নির্বাচনে আমাদের সংগঠন সর্বোচ্চ চেষ্টা ও আন্তরিকতা দিয়ে লড়বে।’
সারাবাংলা/এআইএন/পিটিএম
ছাত্রদল ছাত্রশিবির ড. নিয়াজ আহমেদ খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন ভিসি সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট