পাকা ধানে সুবাসিত সুনামগঞ্জ, চাল মিলবে ৯০০ কোটি টাকার
৯ নভেম্বর ২০২৪ ১০:০০ | আপডেট: ৮ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:৪০
সুনামগঞ্জ: আমন ধান উঠতে এখনো কিছু সময় বাকি, তবে আগাম জাতের বিনা ধান-১৭ পেকে গেছে মাঠে মাঠে। উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের এই ধান কাটাও হয়ে গেছে সুনামগঞ্জের প্রায় ৭০০ হেক্টর জমি থেকে। বাকি জমিগুলোতে এখন হেমন্তের বাতাসে দুলছে পাকা ধান। তার গন্ধে সুবাসিত হাওর এলাকা। কৃষকরা বলছেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ মৌসুমে আমনের বাম্পার ফলন প্রত্যাশা করছেন তারা।
সুনামগঞ্জের কৃষকরা বলছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার আমনের ফলন অনেক ভালো হয়েছে। খরাসহিষ্ণু ও আগাম জাতের উফশী বিনা ধান-১৭ তারা এরই মধ্যে কাটতে শুরু করেছেন। আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যেই পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে। ফলন ভালো হওয়ায় তারা ভীষণ খুশি।
চলতি আমন মৌসুমের শুরুতে অতি বৃষ্টি ও কয়েক দফা বন্যায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন সুনামগঞ্জের কৃষকেরা। কিন্তু সাম্প্রতিক বৃষ্টিপাত এবং শীত আসতে দেরি হওয়া ধানের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। তাই সব শঙ্কা কাটিয়ে এবার জেলায় আমনের ভালো ফলনে আশার সঞ্চার হয়েছে কৃষকদের মঝে। বাজারে দাম ভালো হওয়ায় তারা আরও বেশি খুশি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, চলতি মৌসুমে ৮৩ হাজার ৩৮০ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। আবাদ হয়েছে ৮৩ হাজার ৪৯৫ হেক্টর জমিতে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১৫ হেক্টর বেশি। এরই মধ্যে প্রায় ৭০০ হেক্টর জমির বিনা ধান-১৭ ধান কাটা হয়ে গেছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে।
বিমল চন্দ্র বলেন, ‘দুই লাখ ১৪ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে আমাদের। এসব চালের দাম হবে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। আমরা আশা করছি, এর চেয়েও বেশি ধান উৎপাদন হবে।’
অনুকূল আবহাওয়ায় বাম্পার ফলন
এ বছর অনুকূল আবহাওয়ার কারণে আমন আবাদে ব্যাপক সাফল্য মিলতে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন কৃষকরা। জামালগঞ্জ উপজেলার কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বৃষ্টি ও বন্যায় প্রথম দিকে কিছু জমির ধান নষ্ট হয়েছে। তবে এরপর আবহাওয়া ছিল অনুকূলে। কিছুদিন আগেও বৃষ্টি হওয়ায় ধানে রোগের আক্রমণ কম। এবার আমি প্রায় ৪৫ একর জমিতে আমন ধান চাষ করেছি। আরও এক-দেড় মাস পরে ধান কাটা শুরু হবে। আশা করছি বাম্পার ফলন হবে।’
উপজেলার আরেক কৃষক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘দেরিতে ধান রোপণ করায় কাটতেও দেরি হবে। আমার জায়গা নিচু, প্রথম দিকে পানিও ছিল। তাই একটু কম জমিতে ধান চাষ করেছি, পাঁচ-ছয় একর হবে। এমনিতে ফলন ভালোই হয়েছে, ধানের ছড়াও এসেছে। মাসখানেক পরে ধান কাটা শুরু হবে। আরও কিছুদিন আবহাওয়া ও বাজারদর ভালো থাকলে কৃষকদের জন্য তা মঙ্গলজনক হবে।’
বিশম্ভরপুর উপজেলার ধান চাষি শুকুর আলী বলেন, ‘শীত এখনো পড়েনি, মাঝে বৃষ্টি হয়ে গেছে। এ কারণে ফলন ভালো হবে। সাড়ে ৮-৯ কানি জমিতে আমরা ৪৬ আমন ও কৃষি অফিসের দেওয়া হাইব্রিড ধানের চাষ করেছি। বিনা ধানের আবাদও ভালো হয় শুনেছি। একজনের ধান ভালো হলে পরের বছর আরও ১০ জনে লাগায়। সামনে এই ধানের চাষ আশা করি বাড়বে।’
আরেক চাষি ইন্দ্রলাল দেবনাথ বলেন, ‘কিছু জমির ধান পাকতে শুরু করেছে। খুবই ভালো ধান হয়েছে। ৮৭, ২২, দেশি জাতের জাইন্দা ও ৪৯ জাতের ধানের চাষ করেছি। তবে ৮৭ জাতের ধানের চাষ বেশি হয়েছে, এরপর রয়েছে ২২। সবগুলোতেই ভালো ফলন হবে আশা করছি।’
প্রথম দিকে ধান ক্ষেতে পোকার আক্রমণ থাকলেও পরবর্তী সময়ে আর কোনো সমস্যা হয়নি বলেও জানালেন কৃষকরা।
আর বাজার হাসি ফুটিয়েছে কৃষকদের মুখে
আবহাওয়ার কারণে বাম্পার ফলন হাসি ফুটিয়েছে কৃষকদের মুখে। ধানের বর্তমান বাজারদর সেই হাসিকে আরও বিস্তৃত করেছে। এ রকম আবহাওয়া ও বাজারদর আরও কিছুদিন যেন থাকে, সেটি প্রার্থনা করছেন কৃষকরা।
ধানের দাম দিয়ে সন্তুষ্টি জানিয়ে জামালগঞ্জ উপজেলার কৃষক সাইফুল বলেন, ‘হাইব্রিড জাতের ধানীগুড় ধানসহ স্থানীয় বিভিন্ন জাতের ধান চাষ করেছি। এবার ধানের বাজার দর ভালো। পুরনো চিকন ধান মণ প্রতি ১৬৫০ টাকা ও মোটা ধান ১৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এই দাম পেলে খরচ-কষ্ট সব পুষিয়ে যাবে।
আরেক কৃষক ইন্দ্রলাল দেবনাথ বলেন, ‘১০ একর জমিতে আমন ধান লাগিয়েছিলাম। এর মধ্যে ছয় একর জমির ধান বন্যায় নষ্ট হয়েছে। তবে ফলন ভালো হয়েছে। আবার এখন পর্যন্ত ১৪০০ থেকে ১৪৫০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি হচ্ছে বাজারে। ফলন শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক থাকলে আর ধানের দাম এ রকম থাকলে আশা করি ক্ষতি পুষিয়ে যাবে।’
নতুন আশা বিনা ধান-১৭
জেলায় বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবিত উফশী বিনা ধান-১৭-এর আবাদ দিন দিন বাড়ছে। কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এই ধান আবাদের জন্য জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে বীজ বপন শুরু করেন কৃষকরা। আবাদের জন্য অন্যান্য জাতের ধান থেকে ৩০ শতাংশ কম সার ও ৪০ শতাংশ কম পানি লাগে। পোকামাকড় বা রোগের আক্রমণও অন্যান্য জাতের ধান থেকে তুলনামূলকভাবে কম হয়।
বিনা সুনামগঞ্জ উপকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শেফাউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমিতে বিনা ধান চাষ হয়েছিল। ১৩০০ হেক্টর বেড়ে এবার আবাদ হয়েছে তিন হাজার ২৭৮ হেক্টর জমিতে। প্রতিবছরই এ ধানের আবাদ বাড়ছে। ফলনও খুব ভালো হচ্ছে। আমরা কৃষকদের সচেতন ও এই ধান চাষে আগ্রহী করতে প্রতিটি ওয়ার্ডে সভা করছি।’
বিনার তথ্য আরও বলছে, বিনা ধান-১৭-এর জীবনকাল কম, ফলন বেশি। অন্য জাতের ধান পাকার প্রায় এক মাস আগে এই ধান ঘরে তোলা যায়। শুধু তাই নয়, স্থানীয় জাতের ধানের গড় ফলন যেখানে প্রতি হেক্টরে ৪ থেকে ৫ টন, সেখানে বিনা ধানের গড় ফলন হেক্টরে ৬ দশমিক ৮ টন। হেক্টরে ৮ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায় এই ধানের।
শেফাউর রহমান বলেন, ‘জালা ফেলা থেকে ধান কাটা পর্যন্ত ১১৫-১১৬ দিন সময় লাগে বিনা ধানের জন্য। প্রায় এক-চতুর্থাংশ জমি থেকে এই ধান এরই মধ্যে কাটা হয়ে গেছে। বাকি জমিগুলোতেও বিনা ধান কাটা শুরু হয়েছে। কৃষকরা এখন এই জমিতে সরিষা চাষ করে পরে আবার বোরো ধান চাষ করতে পারবেন।’
দোয়ারাবাজার উপজেলার চন্ডিপুর কৃষি গ্রুপের সভাপতি আবুল কালাম ও ক্যাশিয়ার আসাদ আলী বলেন, বিনা ধান-১৭ চাষ করে প্রতি বিঘায় ১৭ থেকে ১৮ মণ ফলন হয়েছে। চারা লাগানোর ১১৫ থেকে ১২০ দিনের মাথায় তারা ধান কাটতে পেরেছেন। এই জমিতে তারা এখন সরিষা ও পরে বোরো ধান আবাদ করবেন।
সারাবাংলা/এসডব্লিউ/টিআর
আমন ধান পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বাম্পার ফলন বিনা ধান-১৭ সুনামগঞ্জ