‘ছত্রাকনাশক’ ব্যবহারে ফসলের সর্বনাশ, ৩৫ লাখ টাকার ফুলকপি নষ্ট
৭ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:০০ | আপডেট: ৭ নভেম্বর ২০২৪ ০২:৫৭
রাজশাহী: রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার গগনবাড়িয়ায় ফসলের মাঠে ‘নিউজিম’ নামের একটি ছত্রাকনাশক ব্যবহারে কৃষকদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। এতে তাদের প্রায় সাড়ে ৩৫ লাখ টাকার ফুলকপি নষ্ট হয়ে গেছে। এসব কৃষক চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সবজি আবাদ করে এখন দিশেহারা।
এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা মানববন্ধন করেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাছে দিয়েছেন লিখিত অভিযোগ। ছত্রাকনাশক ‘নিউজি’ বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তারা।
নষ্ট হওয়া ফুলকপি দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আবাদ করা কৃষক সেকেন্দার আলী। ফুলকপি দেখে আহাজারি করতে থাকেন। ফসলের খেতে গড়াগড়ি করতে করতে জ্ঞান হারান তিনি। ‘নিউজিম’ নামের ওই ছত্রাকনাশক ব্যবহারে ফসলের সর্বনাশ হওয়ায় ওই কৃষক শোকে জ্ঞান হারান। পরে প্রাথমিক চিকিৎসায় তার জ্ঞান ফিরে। একই অবস্থা আরও ১২ কৃষকের। তারাও একই ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেছেন।
বুধবার (৬ নভেম্বর) সকালে উপজেলার গগনবাড়িয়া ফসলের মাঠে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আহাজারি করতে দেখা গেছে। ওই ছত্রাকনাশক ব্যবহারে তাদের আবাদি ফুলকপির সর্বনাশ হওয়ায় তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
মানববন্ধনে অংশ নেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক শফি কামাল, হযরত আলী, মো. সেকেন্দার, মন্টু, লাল্টু, আজিবর, কামরুল, জারজিদ, রবিউল, ছাতারুল, আতাউর, শহিদুল, হাসান ও স্থানীয়রা।
মানববন্ধনে আসেন চুনিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক সেকেন্দার আলী। তিনি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ২ বিঘা ৩ কাঠা জমিতে ফুলকপি চাষ করেন। সেকেন্দার ছাড়াও আরও কয়েকজন কৃষকের ফুলকপির খেত দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
কৃষক সেকেন্দার বলেন ‘আমার তিন লাখ টাকা কিস্তি। আমরা মরে শেষ। আমাদের বাঁচান। নষ্ট ফুলকপির গাছ ধরে তিনি আহাজারি করতে করতে মূর্ছা যান।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দুর্গাপুর উপজেলার চুনিয়াপাড়া, গগনবাড়িয়া ও সাকোয়া গ্রামের ১৩ জন কৃষক ‘নিউজিম’ নামের একটি ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গগনবাড়িয়া বাজারের মাহামুদা এন্টার প্রাইজ নামের একটি কীটনাশকের দোকান থেকে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ওই ওষুধ বিক্রি করা হয়। এটি বাজারজাত করেছে ব্লেসিং এগ্রোভেট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। প্যাকেটের গায়ে প্রস্তুতকারক হিসেবে লেখা আছে চীনের জিয়াংসু লাফেং বায়োকেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড। নিউজিমের ৫০০ গ্রামের একটি প্যাকেটের দাম ৫০০ টাকা।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ইউএনও’র কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন, তাদের ৪৬৯ শতক জমির ফুলকপি নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের প্রায় ৩৫ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
অভিযোগ পেয়ে ইউএনও সাবরিনা শারমিন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাহানা পারভীন লাবনীকে তদন্ত করতে বলেছেন। মঙ্গলবার কৃষি কর্মকর্তা সরেজমিনে মাঠ পরিদর্শন করেন।
কৃষকেরা জানান, সম্প্রতি নিউজিম ছত্রাকনাশক ব্যবহারের পর ফুলকপির গাছ মরতে শুরু করলে তারা বিক্রেতা ছাতাহার আলীকে অবহিত করেন। ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোতালেব হোসেনকেও জানান। কিন্তু মোতালেব বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাননি। আর বিক্রেতা ছাতাহার আলী ও ব্লেসিং এগ্রোভেটের রাজশাহীর আরএসএম জহুরুল হক কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কালক্ষেপন করেন। এরমধ্যেই বাজার থেকে ওই নিউজিম প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। পরে আর কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে তারা ইউএনওর কাছে অভিযোগ করেন।
চুনিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক শফি কামাল জানান, ছত্রাকনাশক প্রয়োগের একদিন পর তিনি লক্ষ্য করেন, গাছের রঙ হলুদ লাগছে। ধীরে ধীরে হলদে রঙ বাড়তে থাকে। তিনদিন পর ফুলকপির গোড়া পচে খসে পড়তে শুরু করে। এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাতজন কৃষক বিক্রেতাকে জানালে তিনি প্রথমে পাত্তাই দেননি। পরে তারা লালশাক ও ঘাসে পরীক্ষামূলক একই ছত্রাকনাশক স্প্রে করেন। তাতে দেখা যায়, লালশাক ও ঘাসও পচে মরে গেছে।
কৃষক শফি কামালসহ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। পাশাপাশি ব্লেসিং এগ্রোভেটের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাহানা পারভীন লাবনী বলেন, ‘নিউজিম’ আসলে কলায় ব্যবহারের ছত্রাকনাশক। সরেজমিনে গিয়ে তিনি দেখেছেন ফুলকপি গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। নিউজিমের ব্যবহারে হয়েছে কিনা খতিয় দেখা হচ্ছে। এদিকে, পরীক্ষার জন্য কিছু ভালো ফসলের মধ্যে (ফুলকপি গাছে) স্প্রে করে রাখা হয়েছে। দুদিন পর বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা হবে।
কৃষক ও দোকান থেকে নিউজিমের নমুনাও সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষায় যদি দেখা যায় নিউজিম ব্যবহারে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন
তাহলে বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কৃষকদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়ও থাকবে।
ব্লেসিং এগ্রোভেটের প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট অফিসার মো. মাসুম দাবি করেন ‘নিউজিমের কোন সমস্যা নেই। একই প্রোডাক্ট সেইম ডোজে রংপুরেও ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে কোনো সমস্যা হয়নি। দুর্গাপুরের কৃষকদের ক্ষতি অন্য কোনো কারণে হতে পারে।’
সারাবাংলা/এসআর
কৃষক ক্ষতিপূরণ দাবি চড়া সুদে ঋণ ছত্রাকনাশক’ ব্যবহার দিশেহারা দুর্গাপুর নিউজিম ফসলের সর্বনাশ ফুলকপি মানববন্ধন রাজশাহী