পুলিশের যারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে
৭ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:০৬
ঢাকা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ বিভাগ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এর পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে ধীরে ধীরে কাজে ফেরে পুলিশ। বলতে গেলে এক সপ্তাহের বেশি সময় পুলিশবিহীন চলে দেশ। অনেকের মতে প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাসে এমনটা হয়নি। এদিকে, গত ৫ নভেম্বর বর্তমান সরকারের তিন মাস হলেও এখনো অনেক পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দেননি। আবার অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। অবশ্য এরই মধ্যে তাদের পলাতক হিসেবে ঘোষণা করে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়েছে সরকার।
পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ৫ আগস্টের পর অন্তত ১৮৭ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পুলিশ পরিদর্শক পর্যন্ত রয়েছেন। এরা কখনোই কাজে যোগ দেননি। এমনকি বারবার নোটিশ দেওয়ার পরও তাদের দেখা যায়নি। এছাড়া, কাজে যোগ দেওয়াদের মধ্যেও যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে তাদের এরই মধ্যে কর্মস্থল থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে, পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেককে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে বেনজীর আহমেদ, মনিরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, বিপ্লব কুমার সরকার, মেহেদী হাসান, নুরন্নবী চৌধুরী, সঞ্জীব চক্রবর্তী, গাজী মোজাম্মেল হক, বনজ কুমার মজুমদার, কৃঞ্চপদ রায়, আব্দুল বাতেনসহ অনেক পুলিশ কর্মকর্তা পলাতক রয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ ভারতে, কেউ মালয়শিয়ায়, আবার কেউ অন্য কোনো দেশে পলাতক রয়েছেন।
জানা গেছে, বিপ্লব কুমার সরকার লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়েছেন। সিটিটিসির আসাদুজ্জামান রিপনও বেনাপোল এলাকার সীমান্ত দিয়ে পালিয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে। সঞ্জীব চক্রবর্তী ভারতে পালানোর পর সেখান থেকে মালয়েশিয়াতে চলে যান। মালয়েশিয়াতে তার সেকেন্ড হোম রয়েছে। এর বাইরেও অনেক পুলিশ কর্মকর্তার মালয়শিয়াতে সেকেন্ড হোম রয়েছে বলে তথ্য আছে।
কেউ পলাতক, আবার কেউ গ্রেফতার হলেও এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা। যার মধ্যে রয়েছে ডিবির হারুনুর রশীদ হারুন। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম দোসর হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন প্রভাবশালী এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি কোথায় আছেন সেটিও স্পষ্ট নয়। তবে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণকারী মাঠ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার না করায় জনমনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
ডিবির হারুন আলোচনায় আসেন ২০১১ সালের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বিএনপি নেতা জয়নাল আবদিন ফারুককে ওই সময় সংসদ ভবন এলাকায় শারীরিকভাবে আঘাত ও লাঞ্ছিত করেন হারুন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জয়নাল আবদিন ফারুক নিজেই বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেছেন। এ পর্যন্ত আলোচিত কর্মকর্তার হারুনের বিরুদ্ধে ৩৮টি মামলার রেকর্ড পাওয়া গেছে।
সর্বশেষ এই কর্মকর্তা ডিএমপি ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে বেশি সমালোচিত হন। ৫ আগস্টের পর থেকে তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। রাজনীতিকসহ আলোচিত বেশ কয়েকজনকে দুপুরের খাবার পরিবেশন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে সমালোচিত হন হারুন। এক পর্যায়ে ডিবি কার্যালয়কে ‘হারুনের ভাতের হোটেল’ হিসেবে অনেকে ব্যঙ্গ করতে শুরু করেন, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
এদিকে, বাধ্যতামূলক অবসর ছাড়াও আরও অনেক পুলিশ কর্মকর্তা কর্মস্থলে যাচ্ছেন না। এদের মধ্যে অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার নুরুন্নবী, অতিরিক্ত ডিআইজি এসএম মেহেদী হাসান ও অতিরিক্ত ডিআইজি সঞ্জিত কুমার রায়। যাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের আগে-পরে সংঘটিত হতাহতের ঘটনায় একাধিক মামলা করা হয়েছে।
এছাড়া, অসুস্থতার আবেদন করে কর্মস্থলে যাচ্ছেন না অতিরিক্ত ডিআইজি উত্তম কুমার পাল, এসপি আবু মারুফ হোসেন, শাহ নুর আলম পাটোয়ারী, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রওশানুল হক সৈকত, এএসপি মফিজুর রহমান পলাশ, এএসপি আরিফুজ্জামান, এএসপি আল ইমরান হোসেন, এএসপি ইফতেখার মাহমুদ। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বহুল আলোচিত আরেক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান।
এদের বাইরে এএসপি মি. জন রানা ৫ আগস্টের আগেই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার তথ্য জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। তিনি ২ আগস্ট পুলিশের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। রংপুর ডিআইজি কার্যালয় থেকে সেটি পুলিশ সদর দফতর হয়ে ২৮ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠানো হয়। পলাতকের ১৮৭ জনের এই তালিকায় পাঁচ জন ইন্সপেক্টরও আছেন। এ ছাড়া ১৪ জন এসআই, নয় জন এএসআই, সাত জন নায়েক এবং ১৩২ জন কনস্টেবল রয়েছেন। এই কনস্টেবলদের মধ্যে দু’জন নারী সদস্যও আছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরের ইতিহাসে চরম ইমেজ সংকটে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও দেশের কোথাও এখন আর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার মতো সক্ষমতা পুলিশ গড়ে তুলতে পারেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন ঠেকাতে যেভাবে নির্বিচারে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। এর সব দায় এখন পুলিশের সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর পড়েছে।
এদিকে, মনোবল ভেঙে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের উজ্জীবিত করতে কাজ করছেন প্রায় ২০ বছর ধরে পদ-পদোন্নতি বঞ্চিত ১২, ১৫, ১৭, ১৮, ২০, ২২ ও ২৪ বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তারা। ছাত্র আন্দোলনের মতো পুলিশেও আছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। তবে এটা বাইরে প্রকাশ হয় না। অন্তত দুই দশক ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা মানসিক ট্রমা নিয়ে বেঁচে আছেন। অথচ দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকা পুলিশের এ কর্মকর্তাদের এই সংকটময় মুহূর্তে কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, যেসব পুলিশ কর্মকর্তা জুলাই-আগস্ট ম্যাসাকারে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা যাতে দেশ থেকে পালাতে না পারেন সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ অধিদফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেফতার করা হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্ত মতে, যেসব পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে যোগ দেননি তাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সবাইকে নোটিশ পাঠিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তদন্তে কারও কোনো অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম