‘আ.লীগ উঁকিঝুঁকি মারছে, দ্রুত নির্বাচনের দিকে যেতে হবে’
৯ নভেম্বর ২০২৪ ১৯:৪৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: আওয়ামী লীগ উঁকিঝুকি মারছে– এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষ্যে শনিবার (৯ নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপি আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি এ আহ্বান জানান। নগরীর ওয়াসা মোড়ে জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাবেশ শেষে বর্ণাঢ্য র্যালি বের হয়। এতে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের হাজারো নেতাকর্মী অংশ নেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ‘৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাংলার মানুষ শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন। বাংলাদেশে এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান, বাকশাল, আওয়ামী লীগ, ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল ৭ নভেম্বর। সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার মধ্য দিয়ে, এক নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছিল। সেই বাংলাদেশে ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্রের বাংলাদেশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বাংলাদেশ, মুক্তবাজার অর্থনীতির বাংলাদেশ, আইনের শাসনের বাংলাদেশ, জীবনের নিরাপত্তার বাংলাদেশ, স্বাধীন-সার্বভৌম হিসেবে মাথা উঁচু করার বাংলাদেশ।’
স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘৭ নভেম্বরের ধারা অব্যাহত রেখে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নব্বইয়ের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছিলেন, স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছিলেন। বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচারকে বিদায় করে শুধু বহুদলীয় গণতন্ত্র নয়, সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেছিলেন। গণতন্ত্রকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।’
১/১১-এর প্রেক্ষাপট টেনে তিনি বলেন, ‘১/১১ পরবর্তী সময়ে কিছু লোক আবারও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। ১/১১ পরবর্তী সময়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে, দেশের ভেতরে ষড়যন্ত্র, দেশের বাইরের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিএনপিকে সেদিন তারা পরাজিত করেছিল। যে স্বৈরাচারকে ফের ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। সেই শেখ হাসিনা জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছিল কেয়ারটেকার সরকার তুলে নিয়ে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় জেলে দিয়ে, বিএনপির সব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে, নির্মম নির্যাতন, গুম, খুন করে সেদিন বাংলাদেশকে ফের জনগণের জন্য নিরাপত্তাহীন করেছিল। সেদিন আবারও দেশনেত্রী রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। রুখে দাঁড়ানোর কারণে তাকে জেলে যেতে হয়েছে, তিনি জীবনের সঙ্গে লড়াই করেছেন, চিকিৎসা না দিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর পরের আন্দোলন তারেক রহমান সাহেবের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল দেশের সমস্ত মানুষেকে উদ্বুদ্ধ করে, সর্বস্তরের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে আমরা আন্দোলন করে শেখ হাসিনাকে মোটামুটি পরাস্ত করতে পেরেছিলাম। প্রত্যেকটি বিভাগীয় শহরে আমরা সমাবেশ করেছিলাম, লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবনের বিনিময়ে, সবকিছু উপেক্ষা করে তারা সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। এরপর ঢাকায় আমরা বিশ-ত্রিশ লাখ মানুষের সমাবেশ করেছিলাম। গুলি করে সেই সমাবেশ ভাঙতে চেয়েছিল, কিন্তু তারেক রহমানের নেতৃত্বের কারণে শেখ হাসিনার প্ল্যান সফল হয়নি। দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে শেখ হাসিনার পরিকল্পনা পরাস্ত করেছিল। সেই ধাক্কা খেয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে।’
শেখ হাসিনার পতনের পর এখন নতুন, নতুন গল্প শোনা যাচ্ছে- মন্তব্য করে বিএনপির এ শীর্ষ নেতা বলেন, ‘আমরা যদি পটভূমি তৈরি না করতাম, সেই অবস্থার সৃষ্টি না করতাম, তাহলে শেখ হাসিনাকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর কোনো সুযোগ ছিল না। এখন অনেক গল্প শুনছি। শেখ হাসিনার পতনের পর এখন গল্পের কোনো শেষ নেই, প্রতিদিন নতুন, নতুন গল্প শুনছি। অনেকেই বলছেন, ওরা না কি এটা করেছে, ওরা না কি সেটা করেছে।’
তিনি বলেন, ‘১৫ বছর আমরা যখন রাস্তায়-রাস্তায় আন্দোলন করেছি, জীবন দিয়েছি, গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছি, গুমের শিকার হয়েছি, জেলে গিয়েছি বারবার, তখন তো আমাদের সঙ্গে কেউ আসেনি। আমাদের নেতাকর্মীদের ১৫ বছর পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, চাকরি হারাতে হয়েছে, ব্যবসা হারাতে হয়েছে, পঙ্গু হতে হয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীদের জেলে যেতে হয়েছে, সারাদেশে কত নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে, কত নেতাকর্মী জেলখানায় চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে, কত নেতাকর্মী পুলিশের হেফাজতে মারা গেছে! আর তোমরা কয়জন?’
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আরও বলেন, ‘হিসাব-কিতাব করলে কিন্তু অসুবিধা আছে। আমরা কিন্তু হিসাব-কিতাব করতে চাই না। আমরা বলছি, আমরা সবাই মিলে শেখ হাসিনাকে বিদায় করে দিয়েছি। এখন আমরা সবাই মিলে দেশে যেন গণতান্ত্রিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারি। দেশবাসী তাদের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচন করবে, সংসদে যাবে, সরকারে যাবে, তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, জবাবদিহি থাকবে।’
‘জবাবদিহিতাহীন কোনো সরকার বাংলাদেশের কল্যাণ করতে পারে না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমি আবার পরিষ্কার করছি, জনপ্রতিনিধিত্বহীন কোনো সরকার জনগণের কথা বুঝবে না, জনগণের ভাষ্য বুঝবে না। কারণ, জনগণের কথা বুঝতে হলে জনগণের কাছে যেতে হবে, জনগণের সঙ্গে থাকতে হবে, জনগণের দুঃখদুর্দশা বুঝতে হবে, দ্রব্যমূল্য কী সেটা বুঝতে হবে, জনগণ বিদ্যুতের বিল দিতে পারছে না সেটা বুঝতে হবে, মানুষ দু’বেলা খেতে পারছে না সেটা বুঝতে হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের ‘বয়ানে’ নির্বাচন না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমীর খসরু বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান, উনি একটা বয়ান দিয়ে কিছুদিন স্বৈরাচারী কায়দায় রাষ্ট্র চালিয়েছিলেন। সেই বয়ানে বলা হয়েছিল, দেশকে একদলীয়করণ না করলে দেশ না কি চলবে না। কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না, শুধু একটি দল ছাড়া, কথা বলার স্বাধীনতা নেই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও বয়ান দিয়ে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন। তাকে আমরা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন করে পরাজিত করেছি। মুক্তিযুদ্ধের বয়ান দিয়ে খুন-গুম করে শেখ হাসিনা কিছুদিন চালিয়েছিল। সেটা আজকে নাই। জনগণের সমর্থন ছাড়া কিছু টিকে থাকে না।’
আমীর খসরু বলেন, ‘তারপর এখন শুনছি আরেক বয়ান। বাংলাদেশে কবে নির্বাচন হবে, সেটা এ বয়ানের মধ্যে নেই। বাংলাদেশের জনগণ কবে ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচিত করবে, সেই বয়ান নেই। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কবে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হবে, সেই বয়ান নেই। এখন হচ্ছে সংস্কারের বয়ান। আরে সংস্কার কি আমাদের আগে আপনারা দিয়েছেন? ছয় বছর আগে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংস্কারের কথা বলেছেন। আমরা জনগণের কষ্ট বুঝেছি বলে দিয়েছি। তখন কারও মুখে সংস্কারের কথা শুনিনি। একবছর আগে তারেক রহমান সাহেবের নেতৃত্বে আমরা ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। সেই প্রস্তাবে সবকিছু আছে, কিছু বাকি নেই, আপনারা যা বলছেন সেটাও আছে, সেটাই বাইরেও আছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু এটুকু বলি, যে কয়টি সংস্কার জাতীয় ঐক্যমতের পরিপ্রেক্ষিতে হবে, সেটুকু সংস্কার করে দিন। তারপর নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যান। যে সংস্কারে ঐক্যমত্য হবে না, সেটা বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নেবে আগামীদিনে। নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ হবে তারা সিদ্ধান্ত নেবে, সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। এর বাইরে অনির্বাচিত কারও কোনোকিছু করার অধিকার নেই। জাতীয় ঐক্যমতের পরিপ্রেক্ষিতে যা কিছু সহসা হবে, সেগুলো করে দ্রুত নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জাতি তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি দেখতে চায়। তাদের নির্বাচিত সরকার দেখতে চায়।’
‘তারেক রহমান সাহেব বলেছেন- এ সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না, তাদের আমরা শেষ পর্যন্ত সমর্থন দেব। এ সরকার যখন এসেছে, আমরা সমর্থন দিয়েছি, আমরা এখনও সমর্থন দিচ্ছি। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। আমাদের ঐক্য নষ্ট করা যাবে না।’
‘আওয়ামী লীগ উঁকিঝুকি মারছে, ফ্যাসিস্টরা উঁকিঝুকি মারছে’ – এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আমীর খসরু বলেন, ‘এ ঐক্য ভাঙা যাবে না, জাতীয় ঐক্য। তারেক রহমান সাহেব যে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, অটুট রাখতে হবে। অটুট রেখে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে যেতে হবে, নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। নির্বাচিত সরকারের দিকে যেতে হবে, নির্বাচিত সংসদের দিকে যেতে হবে, যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।’
দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘রাজনীতি করতে হলে শৃঙ্খলা থাকতে হবে। যারা সুশৃঙ্খলভাবে রাজনীতি করতে পারবে, তাদের ভবিষ্যৎ আছে। উচ্ছৃঙ্খল, চাঁদাবাজ, দখলদার, ভূমিদস্যু– এদের জায়গা বিএনপিতে হবে না।’
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানের সঞ্চালনায় সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার ও ফজলুল হক, কেন্দ্রীয় বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক হারুনুর রশিদ ও মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন এবং নগর কমিটির সাবেক সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর বক্তব্য দেন।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম
আওয়ামী লীগ আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী উঁকিঝুঁকি টপ নিউজ বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য