Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেয়াদ ‘শেষে’ও অগ্রগতি ১৫%, থমকে আছে ৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কাজ

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১০ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৪০

নড়াইলে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের জন্য নির্ধারিত স্থান। এরপর কাজ কিছুটা এগোলেও মেয়াদ শেষে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১৫ শতাংশ। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: পরিকল্পনাতেই গলদ। প্রকল্পের ব্যয় হাজার কোটি টাকার বেশি হলেও করা হয়নি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা। ফলে যা হওয়ার, তাই হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে দেখা গেছে নানা জটিলতা। প্রকল্পের মেয়াদ দুই বার বাড়ানোর পরও সেই বর্ধিত মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু চার বিভাগে চারটি মানসম্মত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনের প্রকল্পটি চরম ধীরগতিতে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।

‘চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে একটি করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন’ প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর। ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ২২২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম বিভাগের খাগড়াছড়ি, খুলনা বিভাগের নড়াইল, রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ ও রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁওয়ে চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর।

বিজ্ঞাপন

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার ছিল তিন বছরের মধ্যে। কিন্তু শুরু থেকেই প্রকল্পটি ছিল স্থবির। যে কারণে প্রথম দফায় এক বছর ও দ্বিতীয় দফায় আরও তিন বছর বাড়িয়ে মোট সাত বছর মেয়াদ করা হয়। দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়েও লাভ হয়নি। এই মুহূর্তে বর্ধিত মেয়াদের বাকি আর মাত্র সাত মাস, বলতে গেলে শেষই হয়ে এসেছে। কিন্তু প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশে। আর্থিক অগ্রগতি আরও কম— মাত্র ৭ শতাংশ।

প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ফয়সাল মুফতিও স্বীকার করে নিচ্ছেন প্রকল্পের ধীরগতির কথা। তার মন্তব্য, একটি প্রকল্প শুরুর আগে যে ধরনের পূর্বপরিকল্পনা প্রয়োজন, তার কিছুই এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে করা হয়নি। ফলে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানা জায়গায় হোঁচট খেতে হয়েছে। সে কারণেই প্রকল্পটির অগ্রগতি এত কম।

বিজ্ঞাপন

থমকে থাকা প্রকল্পটিতে এখন নতুন করে দ্বিতীয় অঙ্গ সমন্বয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি নিয়ে আগামীকাল সোমবার (১১ নভেম্বর) প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) রেহানা পারভিন।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবটি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের শিক্ষা অনুবিভাগ বলছে, প্রকল্পটির একবার সংশোধন, একবার আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় ও দুইবার ব্যয় না বাড়িয়েই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। একই প্রকল্পের ক্ষেত্রে সংশোধন, একাধিকবার মেয়াদ বৃদ্ধি ও একাধিকবার আন্তঃঅঙ্গ সমন্বয় কাম্য নয়। প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে দ্বিতীয়বার আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় প্রস্তাবের যৌক্তিক কারণ নিয়ে সভায় প্রশ্ন তুলবে শিক্ষা অনুবিভাগ।

সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমীক্ষা ছাড়া এত টাকার প্রকল্প গ্রহণ কোনভাবেই কাম্য নয়। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না থাকার কারণেই বাস্তবায়ন পর্যায়ে এমন স্থবিরতা বিরাজ করছে। পরিকল্পনা কমিশনের উচিত বিষয়টি কঠোরভাবে দেখা। এখানে কার গাফিলতি আছে, সেটিও খতিয়ে দেখা উচিত।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিকল্প কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নানা ধরনের শর্ত পূরণ না করায় তারা অনেক প্রকল্পই অনুমোদনের জন্য ছাড় করতেন না। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক প্রভাবে অনেক প্রকল্পকে ছাড় দিতে হয়েছে। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে প্রকল্পের পর প্রকল্প নেওয়া হবে, কিন্তু বাস্তবায়ন আর হবে না। অপচয় হবে সময়ের, অর্থের।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) প্রকৌশলী ফয়সাল মুফতি সারাবাংলাকে বলেন, এই প্রকল্পের অধীনে একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন ও মাল্টিপারপাস ভবন নির্মাণের অনুমোদন ছিল। কিন্তু একাডেমিক ভবন নির্মাণের আগে গবেষণাগার ও পাঠ্যক্রম প্রণয়ন প্রয়োজন ছিল। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে সেই কাজটি করতে গিয়ে অনেক বেশি সময় লেগে যায়। এখন প্রশাসনিক ভবনের কাজ আগাচ্ছে। নতুন রেট শিডিউল ও কিছু আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় প্রয়োজন। পিইসি সভায় সেগুলো অনুমোদন পেলে দরপত্র আহ্বান করে একাডেমিক ভবনের কাজ আমরা এগিয়ে নেব।

২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে এই প্রকল্পের পিডির দায়িত্বে রয়েছেন প্রকৌশলী ফয়সাল মুফতি। তিনি বলেন, আমাদের দেশে সবারই উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহ আছে। কিন্তু ডিপ্লোমা ও কারিগরি শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার জায়গা খুব একটা নেই। তাই ডিপ্লোমা ও কারিগরি শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে এই চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু একটি প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে যে পরিকল্পনা প্রয়োজন কিংবা পূর্বপ্রস্তুতি প্রয়োজন, তার কিছুই এ প্রকল্পের জন্য করা হয়নি। সে কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে। পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে সেগুলো প্রয়োজন ছিল, সেগুলোর কাজ মোটামুটি শেষ। আশা করছি, এরপর প্রকল্পটি সংশোধনের পর দ্রুত কাজ শেষ করা যাবে।

চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনের প্রকল্পটির দ্বিতীয়বার আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয়ের প্রস্তাব সম্বলিত আরডিপিপি (সংশোধিক প্রকল্প প্রস্তাবনা) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর প্রথম আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয়ের সময় আরডিপিপিতে ১৮টি নতুন অঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু ২০২২ সালের জুনে জারি করা নির্দেশিকা অনুযায়ী, আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রকল্পের অনুমোদিত অঙ্গগুলোর ব্যয় কেবল কমানো-বাড়ানো যায়, অঙ্গের সংখ্যার পরিবর্তন করা যায় না। ফলে ১৮টি নতুন অঙ্গ আরডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাখ্যা চাইবে পরিকল্পনা কমিশন।

প্রকল্পের দ্বিতীয় আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় প্রস্তাবে কিছু অঙ্গ যেমন— ওয়ার্কশপ, সেমিনার, পিআইইউ কর্মচারীদের বেতন, আপ্যায়ন ব্যয়, প্রিন্টিং ও বাইন্ডিং, মনিহারি পণ্য, সম্মানি, মোটরযান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী— এসব খাতে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি বছরের এ সব অঙ্গের বাস্তব ও আর্থিক অগ্রগতি ও প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে এ খাতে ব্যয় বাড়ানোর কারণ নিয়েও সভায় আলোচনা করা হবে।

এর আগে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ চলতি বছরের ৩ জুন দ্বিতীয় আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে অপ্রত্যাশিত ব্যয় অঙ্গটি আরডিপিপি থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে গত ৭ জুলাই পরিকল্পনা কমিশন একটি চিঠি দেয়। কিন্তু প্রস্তাবিত আরডিপিপিতে অপ্রত্যাশিত ব্যয় অঙ্গে এক লাখ ১৭ হাজার টাকার সংস্থান থেকে ৩৯ লাখ টাকা ব্যয় অন্যান্য অঙ্গে স্থানান্তর করা হয়েছে।

এদিকে অনুমোদিত মূল ডিপিপি, অনুমোদিত প্রথম সংশোধিত উন্নয়ন প্রস্তাব (ডিপিপি) এবং অনুমোদিত প্রথম আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় ডিপিপিতে ওয়ার্কশপ, সেমিনার ও কনফারেন্সের সংখ্যা পাঁচটি। দ্বিতীয় আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় প্রস্তাবের পরিমাণ পাঁচটির পরিবর্তে ১০টি করা হয়েছে। পেশাগত সেবার সংখ্যা আগের ৯টি বিভাগের জায়গায় বর্তমানে ছয়টি বিভাগের প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব বিষয়ে সভায় প্রশ্ন তোলা হবে।

সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর একনেক সভায় অনুমোদন পায়। পরে মন্ত্রণালয় ব্যয় না বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করে। এরপর প্রচলিত আইবাসের নতুন ইকোনমিক কোড অন্তর্ভুক্তি, বিভিন্ন অঙ্গে কোডে ব্যয় সমন্বয়সহ প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করার জন্য ২০২১ সালের ২১ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী অনুমোদন দেন। এরপর প্রকল্পের আওতায় একটি বিভাগের প্রকল্প এলাকা পরিবর্তনসহ ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া দেরি হওয়ায় পরিকল্পনা কমিশন ব্যয় না বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ দ্বিতীয়বার তিন বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকল্পটি শেষ করতে কত সময় লাগতে পারে— জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ফয়সাল মুফতি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি সুনির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল। প্রকৃত অর্থে প্রকল্পের মূল কাজ কথা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একাডেমিক ভবন নির্মাণের কাজেই শুরু হয়নি। সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সেটি শুরু করা গেলে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে। প্রকল্পটির আরও একটি সংশোধনী প্রস্তাব প্রণয়ন করতে হবে। সেটি করার সময় আমরা যৌক্তিক একটি সময় চাইব।’

সারাবাংলা/জেজে/টিআর

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর প্রকৌশল কলেজ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর