Sunday 01 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যানসার নির্ণয় কর্মসূচি প্রকল্পে ‘নয়ছয়ের’ অভিযোগ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১২ নভেম্বর ২০২৪ ২০:০৮ | আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৪ ২০:১৪

জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হক হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন

ঢাকা: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ‘ইলেক্ট্রনিক ডাটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যানসার নির্ণয় কর্মসূচি’ শীর্ষক প্রকল্পে কর্মরত ৬৯ কর্মচারীর বেতন ও সম্মানী বাবদ প্রায় সাত কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে।

এছাড়াও ভাতা পরিশোধের আহ্বান জানানোর কারণে প্রকল্প শেষের আগেই বেতন না দিয়ে ৬৯ জনকে অব্যাহতি দেয়ার অভিযোগ জানিয়েছে প্রকল্পে কর্মরত চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হক হলে আয়োজিত এক সম্মেলনে এমন অভিযোগ জানায় তারা।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘ইলেক্ট্রনিক ডাটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যানসার নির্ণয় কর্মসূচি’ শীর্ষক প্রকল্পটি জুন, ২০১৮ থেকে ২০২১ মেয়াদে সারা দেশে জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রদানে কাজ করে। পরবর্তীতে ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ মেয়াদের দুইবার সংশোধন ও মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, বর্তমানে ২০২৪-২৫ মেয়াদের নো-কস্ট এক্সটেনশনের মাধ্যমে পুনরায় মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্পটি চলমান রয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ৬০১টি স্ক্রিনিং কেন্দ্র স্থাপন করেছে এবং ৫০ লাখের অধিক মহিলাকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। এই কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য প্রকল্পের আওতায় ৬৯ জন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-কর্মকর্তা-কর্মচারী আউটসোর্সের প্রক্রিয়ায় নিয়োগ প্রদান করা হয়।

বিজ্ঞাপন

সংবাদ সম্মেলনে প্রকল্পে কর্মরত চিকিৎসক ডা. সাদিয়া মাহবুব রিপা জানান, ‘প্রকল্পের জনবল নিয়োগকালে প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা সকল জনবলকে জানায় যে, প্রকল্পের জনবলের জন্য সরকার থেকে বেতন ছাড়া অন্য কোনো ভাতা বা সম্মানী দেওয়া হয় না। তবে প্রকল্প সমাপ্তিতে একটি ইন্সটিটিউট স্থাপন করে সকল জনবলকে আত্মিকরণ করা হবে। কিন্তু গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর প্রকল্প পরিচালক হঠাৎ করেই জানায় বর্তমান প্রশাসন তার অনুকূলে না থাকায় উনি স্থায়ীকরণের ব্যাপারে কিছু করতে পারবেন না।’

তিনি বলেন, ‘তখন কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ বিএসএমএমইউ এর প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তার সাথে দেখা করে এবং প্রকল্পের বিভিন্ন কাগজপত্র যোগাড় করতে গিয়ে দেখতে পায় প্রকল্পের শুরু থেকেই মূল বেতন ছাড়াও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্য ক্যাম্পে সম্মানী বাবদ প্রত্যেক প্রশিক্ষক, কো-অর্ডিনেটর, ফ্যাসিলিটেটর ও অংশগ্রহণকারীর জন্য বরাদ্দ রয়েছে। তখন প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ আরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা শুরু করে এবং প্রকল্পের সীমিত কিছু নথি থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় প্রায় ৭ কোটি টাকার অধিক টাকা প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে সরকার থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। হয়ত আরও তথ্য পাওয়া গেলে ন্যায্য প্রাপ্যর পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রাপ্য টাকা চেয়ে ৭ অক্টোবর প্রকল্প পরিচালকের কাছে চিঠি দিয়ে প্রাপ্য সকল টাকা বুঝিয়ে দিতে বলা হলে প্রকল্প পরিচালক আত্মসাৎকৃত টাকা প্রদান করতে অস্বীকার করে। উনি জানান প্রকল্প পরিচালনায় নানাবিধ হিসাব বহির্ভূত ব্যয় যেমন— মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ডেস্ক ‘ম্যানেজ করা’, অডিট সামলানো, গাড়ি ভাড়া ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এই টাকাটা উনি উত্তোলন করেন। আমরা তাকে বলি, উনি তো প্রকল্পের জনবলের প্রাপ্য টাকা কেটে প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন না। প্রকল্প পরিচালক বিভিন্ন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি দিয়ে হুমকি দেওয়া শুরু করেন এবং গাইনোকোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিরিন আক্তার বেগম আমাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেন ও আমাদের চাকুরিচ্যুত করবেন বলেন।’

এ বিষয়ে বিএসএমএমইউ প্রশাসন সহযোগিতা করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গত ২৬ অক্টোবর বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক সাইদুর রহমান স্যারের সাথে আমরা দেখা করতে পারি এবং ন্যায্য প্রাপ্য টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলে তদন্ত কমিটি গঠনে সম্মতি ও সিন্ডিকেট সভার পর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান। তবে সিন্ডিকেট সভার পরও কোনো তদন্ত কমিটি গঠন হয়নি। অন্যদিকে আমরা জানতে পারি প্রকল্পের সকল জনবলকে চাকুতিচ্যুত করে প্রকল্প পরিচালককে রক্ষা করার একটি পায়তারা করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়কে সামনে রেখে আমরা প্রো-ভিসি (প্রশাসন), রেজিস্টার ও হাসপাতাল ডিরেক্টরের সাথে দেখা করতে গেলে বিএসএমএমইউর হাসপাতাল পরিচালক জানান, মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে এই প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মকারীদের জুন, ২০২৪ থেকে চাকুরী থেকে অব্যাহতি দেখানোর প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। আমরা বুঝতে পারি, প্রকল্প পরিচালকের এই অর্থ আত্মসাতের সাথে জড়িত সকলে মিলে বিএসএমএমইউ এর বর্তমান প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়কে প্রভাবিত করে দূর্নীতিকারীদের রক্ষার জন্য ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত প্রকল্পের আরেক কর্মচারী ডা. কাইয়ুম খানম জানান, ‘এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ পর্যন্ত করা হয়। জুলাই ২০২৪ থেকে বেশকিছু জেলা ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ঢাকা থেকে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও আমাদের ন্যায্য প্রাপ্তির দাবীতে আমরা কর্মবিরতিতে যাবার উদ্যোগ গ্রহণ করলে বিএসএমএমইউ এর হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার রেজাউর রহমান এসে আমাদের কাজে ফিরতে অনুরোধ করেন এবং প্রকল্প পরিচালককে জিজ্ঞাস করেন জুন, ২০২৫ পর্যন্ত প্রকল্প চলমান থাকলে তারপরে কি হবে? প্রকল্প পরিচালক বলেন জুন, ২০২৫ পর্যন্ত সকলের বেতন দিতে পারবো কিন্তু তারপরে ইন্সটিটিউট না হলে সকলের চাকরি অনিশ্চয়তায় থাকবে। এ সময় প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছিলেন, তিনি এইচপিভি পরীক্ষা প্রচলনের জন্য আরেকটা প্রকল্প আনার পরিকল্পনা করছেন, সেখানে হয়ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুনরায় নিয়োগ দেওয়া সম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘তবে গত ১০ নভেম্বর হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার রেজাউর রহমান প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জানান, মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে ২০২৪ সালের জুন মাসেই প্রকল্প বন্ধ দেখানো হবে এবং সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর আসার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক আশরাফুন্নেসার দৃশ্যমান ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে কোনো ভূমিকা নেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে একটি তদন্ত কমিটি হবে, হচ্ছে বলে সময়ক্ষেপন করেছে। অন্যদিকে প্রকল্প পরিচালক বিদেশ যাওয়ার আগের দিন সবাইকে একটি নোটিশ লাগিয়ে সবাইকে চাকুরিচ্যুত দেখানো হয়েছে।’

এমন অবস্থায় এ বিষয়ে বিএসএমএমইউ ও সরকারের কাছে সঠিক ভাবে পর্যালোচনা করে ও তদন্ত করে কর্মরতদের প্রাপ্য টাকা পরিশোধ ও প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানায় অভিযোগকারীরা।

সংবাদ সম্মেলনে প্রকল্প পরিচালকের অর্থ আত্মসাতের কথা বলায় প্রকল্পের সকলকে চাকুরিচ্যুত করা কতটুকু আইন সম্মত বিষয়টি জানতে চান তারা।

সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্প পরিচালকের দুর্নীতির দায় থাকলে প্রকল্প পরিচালককে পরিবর্তন করার অধিকার মন্ত্রণালয়ের আছে। কিন্তু প্রকল্প বন্ধ দেখিয়ে মন্ত্রণালয় কেনো সকল সাক্ষ্য দাতাদের সরিয়ে দেওয়ার পায়তারা করছে সে বিষয়েও অভিযোগ জানানো হয়।

এছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগকারীরা যেসব অভিযোগ জানান তা হল—

(১) জুলাই ২০২৪ থেকে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাগণ বিভিন্ন জিও, ওয়ার্কশপে উপস্থিত থাকার পরেও জুন ২০২৪ থেকে কিভাবে প্রকল্প বন্ধ দেখানো হলো?

(২) শ্রম অধিকার আইনের লঙ্ঘন করে নভেম্বর, ২০২৪ এ এসে জু্ন,‌ ২০২৪ থেকে চাকরীচ্যুত করার নোটিশ কিভাবে লাগানো হয়?

(৩) প্রকল্প পরিচালকের দৃশ্যমান দুর্নীতির সাক্ষ্য-প্রমাণ-তথ্য থাকা সত্ত্বেও কোনো তদন্ত না করে তাকে বিদেশ পালানোর সুযোগ করে দেওয়া হলো কার স্বার্থে?

(৪) প্রকল্প পরিচালক সকলকে চাকরিচ্যুত দেখিয়ে বিদেশ গমন করলেও উনার নির্বাচিত কিছু মানুষকে দিয়ে কার্যক্রম চালানোর পরিকল্পনা করছেন যার মধ্যে অধ্যাপক শিরিন আক্তার, ডাঃ আফরোজা, ডাঃ নাসিমা, ডাঃ রোমেনা, এনি আক্তার, আনোয়ারুজ্জামান, ওয়াহিদ, রিমরাসহ আরও কিছু ব্যক্তি উল্লেখযোগ্য। কোন ক্ষমতাবলে এভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন?

সারাবাংলা/এসবি/এইচআই

জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার নির্ণয় কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর