বৈষম্যবিরোধীদের সভায় সিদ্ধান্ত
সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক হবে দ্বন্দ্বের
১৩ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০২
ঢাকা: দেশের চলমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা, প্লাটফর্মের আগামীর রূপরেখা এবং সমন্বয়কদের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি নিয়ে সভা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এতে উপদেষ্টা নিয়োগ ইস্যু নিয়ে ধোঁয়াশা, সরকারের কোনো সিদ্ধান্তে না থেকেও সমালোচনার শিকার হওয়া, সারাদেশে সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখাসহ দেশের নানা ইস্যু নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সমন্বয়করা। সর্বোপরি সরকারের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্পর্ক দ্বন্দ্বের হবে— এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হন সবাই। তারা সরকারের ভালোকাজের প্রশংসা করবেন এবং মন্দ কাজের সমালোচনায় সরব থাকবেন।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অফিসে সাড়ে ৪ ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক হয়। এতে কেন্দ্রীয় ১৫৮ সমন্বয়ককে উপস্থিত থাকতে বলা হলেও সবমিলিয়ে ৬০-৬৫ জন উপস্থিত হন। অন্যদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সদস্যসচিব আরিফ সোহেল, মুখপাত্র উমামা ফাতেমা, মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ প্রশ্নের জবাব দেন।
সভা সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দীনের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। এ সময় জানানো হয়, ফারুকীর ব্যাপারে তারা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। তার ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। তাদের নিয়োগের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়েছে। অন্যদিকে, সেখ বশিরের ব্যাপারে কোনো জবাব আসেনি। তার ভাইয়েরা ফ্যাসিবাদের দোসর হলেও আওয়ামী সময়ে বশির নিগৃহীত হয়েছেন। তবে যেহেতু নিয়োগ হয়েছে ফলে তাদের পর্যবেক্ষণে রাখবেন তারা।
উপদেষ্টাদের কীভাবে নিয়োগ হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে জানানো হয়, ড. ইউনূস ছাড়া বাকি উপদেষ্টাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কাউকে জানানো হয়নি। ফলে এ বিষয়ে তারা জানেন না।
সরকারের নানা বিতর্কিত কাজের জন্য সমালোচনার শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন কয়েকজন সমন্বয়ক। এটির সমাধানকল্পে সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে উপদেষ্টাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং নেগোশিয়েশনের জন্য একটি সেল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। যেখানে তারা নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে জবাবদিহিতা নেবেন।
গত ৩ আগস্ট সরকার পতনের আগে কেন্দ্রীয় ১৫৮ সদস্যের কমিটি দেওয়া হয়। গত ২২ অক্টোবর চার সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়। এতে বাকি সমন্বয়করা পরিচয় সংকটে পড়েছেন জানিয়ে বর্ধিত কমিটি দিতে দেরি হওয়ায় ক্ষোভ দেখান। এছাড়া, ৫ আগস্টের পর কেন্দ্রীয় প্রথম সারির সমন্বয়কদের ফোনে না পাওয়ার অভিযোগ তোলেন দুয়েকজন। এ ব্যাপারে হান্নান মাসউদ জানান, ব্যস্ততার কারণে সপ্তাহে একবারও বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারেন না তারা।
সভা সূত্রে আরও জানা যায়, বৈঠকে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে নিয়ে আবেগঘন বক্তব্য দেন আব্দুল হান্নান মাসউদ। তার বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘মানুষ কোনো দলের জন্য আন্দোলনে আসেনি। তারা শেখ হাসিনাকে হটিয়ে একটি নতুন বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের জন্য আমাদের আহ্বানে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। মানুষ আমাদের বিশ্বাস করেছে। সেই জায়গায় আমাদেরকে একত্র এবং ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের নিজেদের পরস্পরের সম্পর্ক বাড়াতে হবে।’
কয়েকজন সমন্বয়ক অভিযোগ করেন প্রশাসনের কেউ তাদের গোনে না। ডিসি-ইউএনওসহ প্রশাসন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করেছে। কিন্তু মানুষের সমালোচনার ভাগিদার হতে হচ্ছে তাদের। এ ব্যাপারে তারা ক্ষোভ জানান। আবার অনেকে বিএনপির বিরুদ্ধে আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ দেন।
আর্থিক ম্যানেজমেন্ট নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। তারা বলেন, সবাই মনে করে আমরা এতদিনে বহু টাকার মালিক হয়েছি! অথচ আজকের একটি সভা হলো, যেখানে আসার ভাড়াও নিজের পকেট থেকে দিতে হচ্ছে। আর্থিক বিষয় আছে চার সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির কাছে। জবাবে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘কারও থেকে পাঁচ টাকা খাওয়ার প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। পারলে যেকোনো শাস্তি তিনি মেনে নেবেন। এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘অনেকে নানা জায়গায় সমন্বয়ক পরিচয় নিয়ে সুবিধা ভাগিয়ে নিতে চান। সুবিধা না পেলে বলেন, আমি কি আন্দোলন করি নাই? আন্দোলনের দোহাই দিয়ে অন্যায্য সুবিধা চাওয়া অযৌক্তিক।’
সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, ‘আন্দোলনে বাপেরা ছেলেদের ঠেলে দিয়েছে। তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে সফল হওয়ার পর প্রশ্ন তুলছে, বাপের আগে ছেলে হাঁটতে চায় কেন? এমন প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক নয়।’ তিনি দ্রুত আহ্বায়ক কমিটি বর্ধিত করার কথা জানান।
সভা সূত্রে আরও জানা যায়, সংবিধান পুনর্লিখন ও রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে সরানোর ব্যাপারে কয়েকজন প্রশ্ন তোলেন। তবে এ ব্যাপারে খোলাসা কোনো জবাব আসেনি। এটা নিয়ে সামনে কাজ হবে বলে জানানো হয়। এছাড়া, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সেল, মিডিয়ার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখার জন্য সেল, প্লাটফর্মের লক্ষ্য উদ্দেশ্য প্রস্তুত এবং সেই মোতাবেক কাজ করতে গবেষণা সেলসহ একাধিক সেল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।’
সভায় আলোচনার বিষয় নিয়ে সমন্বয়ক আবদুল কাদের বলেন, ‘দুয়েকদিনের মধ্যে একটি নির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে। আহ্বায়ক কমিটির চার জনের বাইরে নির্বাহী কমিটিতে ২০ থেকে ২২ জন সদস্য থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজের প্রতিনিধিসহ জেলা পর্যায় থেকে দুয়েকজন করে প্রতিনিধি নিয়ে নির্বাহী কমিটি গঠিত হবে।’
তিনি বলেন, “আরেকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে ‘অর্গানাইজিং টিম’ গঠনের। এতে সেলভিত্তিক ভাগ করে কাজ করা হবে। কে কোন সেলে থাকবে, সাংগঠনিক কী দায়িত্ব পালন করবে সব এখানে থাকবে। এছাড়া, আহ্বায়ক কমিটি বর্ধিত করে এই মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে অন্যান্য সমন্বয়কদের এতে যুক্ত করা হবে।’
এদিকে, সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। তিনি বলেন, ‘আগামী ১৫ নভেম্বর অভ্যুত্থানের শততম দিন উপলক্ষ্যে একটি কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন সারাদেশে ও ঢাকায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহতদের হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ খবর নেবে এবং শহিদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। একইসঙ্গে জেলা পর্যায়ে যারা প্রতিনিধি আছেন তারা আহত এবং শহিদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
সারাবাংলা/এআইএন/পিটিএম