ভোটের মঞ্চে এক হয়ে যেতে পারে জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলো
১৮ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৪৭
ঢাকা: নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শেষের পথে। প্রধান উপদেষ্টা নিজেও জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছেন, সরকার নির্বাচনের ট্রেন চালু করে দিয়েছে, এ ট্রেন আর থামবে না। সেই ট্রেনে উঠতে রাজনৈতিক দলগুলোও নড়েচড়ে বসেছে। তার মধ্যে রয়েছে ইসলামি দলগুলোও। এসব দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী অন্য দলগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘এক মঞ্চ’ বা ‘প্ল্যাটফর্মে’ উঠবে।
দলগুলোর নেতারা বলছেন, জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যে তারা কাজ করছেন। ইসলামী দলগুলো দলের ভেতরে ও বাইরে অন্য দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। এরই মধ্যে নিবন্ধিত ইসলামী দলগুলোর সঙ্গেবাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতারা আলোচনাও করেছেন। ভোটের মাঠে ঐক্য গড়তে এসব দলের নেতারা মানসিকভাবে কাছাকাছি অবস্থানেও পৌঁছে গেছেন।
তারা বলছেন, ইসলামি শাসন ব্যবস্থা ও ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে তারা আগামী নির্বাচনে তারা ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে ভোটের লড়াইয়ে নামবেন।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৮টি। এর মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে ১১টি— জাকের পার্টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, খেলাফত মজলিস ও ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ।
এর বাইরে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর যাদের নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। এর বিরুদ্ধে দলটি আপিল করলেও তা উচ্চ আদালত খারিজ করে দিয়েছিলেন। সম্প্রতি সেই আবেদন পুনরুজ্জীবিত করার আদেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত, যার সূত্র ধরে দলটি নিবন্ধন ফিরে পথে এক ধাপ এগিয়ে গেছে।
আরও রয়েছে হেফাজতে ইসলাম, যারা অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিলেও ভোটের মাঠে তাদের সমর্থন যথেষ্ঠই প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের বাইরেও বেশকিছু ইসলামি দল আছে। নিবন্ধন না থাকায় তারা নিজেদের প্রতীকে ভোট করতে না পারলেও তাদের সমর্থন নিয়ে অন্য দলগুলো লাভবান হয়ে উঠতে পারে।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত এসব বইসলামি দলের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা তো বটেই, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়েও মসজিদ ও মাদরাসাকেন্দ্রিক যৌথ সভা ও কর্মিসভায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে দলগুলো। এসব বৈঠক এখনো চলছে অনানুষ্ঠানিকভাবে। নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট বা প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার আলোচনাও রয়েছে প্রাথমিক ও অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে। তবে অতীতের ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার বিষয়ে নীতিগতভাবে বেশির ভাগ দলই একমত পোষণ করছে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক ও আধা-আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছে তারা।
সূত্র বলছে, জামায়াতে ইসলামী এরই মধ্যে বেশকিছু দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে। এমন কয়েকটি দলের নেতারা সারাবাংলার এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনের আগেই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলগুলোকে একটি জোট বা প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসাই জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগের মূল লক্ষ্য বলে তাদের কাছে মনে হয়েছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম সারাবাংলাকে জানান, গত শনিবার (১৬ নভেম্বর) সমমনা ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও জোট করার বিষয় নিয়ে তাদের কথা হয়েছে।
মুফতি মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘জোট হতে পারে। এই জোট প্রয়োজনে অন্য রাজনৈতিক দলকেও সহায়তা করবে। তবে সে দলকে অবশ্যই স্বচ্ছ হতে হবে, গণতন্ত্রমনা হতে হবে। সেই দলকে জনগণেরর স্বার্থ রক্ষা ও ইসলামের আদর্শের অনুসারী থাকতে হবে।’
এসব বিষয় নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. মো. শফিকুর রহমান, নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এবং দলের মুখপাত্র ও কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে অন্য ইসলামী দলগুলোর একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, এরই মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং লেবার পার্টি ও বারো দলীয় জোটসহ বেশ কয়েকটি দল ও কয়েকজন ইসলামি ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা।
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইসলামি দলগুলো নিয়ে নির্বাচনি জোট নয়, একটি সমঝোতার চিন্তাভাবনা চলছে। এই সমঝোতা করার জন্য ঘরোয়াভাবে আলোচনা হচ্ছে। এই সমঝোতার বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কথা হচ্ছে। অন্যান্য ইসলামি সমমনাদল গুলোর সঙ্গেও আলোচনা চলছে। এখনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি।’
অধ্যক্ষ ইউনুস আরও বলেন, ‘আমাদের দলটি নির্বাচনমুখী। ফলে সারা বছরই নির্বাচনি বিষয়ের চর্চা আমাদের থাকে। সামনে যেহেতু জাতীয় নির্বাচন, ফলে স্বাভাবিকভাবেই মাঠে আমরা নির্বাচনি চর্চা অব্যাহত রেখেছি। জোট বা সমঝোতা না হলে আমরা এককভাবে নির্বাচন করব। দলের সব স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’
ইসলামি দলগুলোর জোটের আলোচনার কথা স্বীকার করে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আব্দুল কাদের সারাবাংলাকে বলেন, ‘জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করার চিন্তাভাবনা চলছে। নিবন্ধিতসহ সমমনা ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচনি জোট গঠনের প্রাথমিক আলোচনা চলছে। জোট হয়ে নির্বাচন করলে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়া হবে।’
১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৬টি আসনে প্রার্থী দিয়ে এককভাবে ভোট করেছিল বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট। এবারে নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, তার ওপর দলটির ভোটে অংশগ্রহণের ধরন ঠিক করা হবে বলে জানালেন মহাসচিব মাওলানা এম এ মতিন।
সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছি। নির্বাচনি জোট নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। নির্বাচন কী পদ্ধতিতে হয়, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মতো নির্বাচন হলে আমরা এককভাবে ৪০টি আসনে প্রার্থী দেবো। তবে গত কয়েকটি নির্বাচন জোটগতভাবে হয়েছে। সেদিকেও আমাদের খেয়াল রয়েছে।’
নির্বাচন সুষ্ঠু হবে মনে করলে জোটবদ্ধ হয়ে ভোট করার কথা জানিয়ে এম এ মতিন বলেন, ‘১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেসব নির্বাচনে ভোট বেচাকেনা হয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই তিনটি নির্বাচন ভোট বেচাকেনা হয়নি, তবে অটো ভোট হয়েছে। এবার আশা করি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। জোট করার উপযোগী নির্বাচনি সাংস্কৃতি থাকলে আমাদের দল অন্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ভোটে অংশ নেবে। তবে এর কিছুই এখনো চূড়ান্ত নয়।’
বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুসা বিন ইযহার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইসলামি দলগুলোর ঐক্য বা এক প্ল্যাটফর্মে আসার প্রাথমিক আলোচনা চলছে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। মানসিকভাবে সবাই একমত। ইসলামি দলগুলোর ঐক্য প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে।’
নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন পরিচয় দিলেও ইসলামি দলগুলোর রাজনৈতিক আলোচনায় বরাবরই সামনে চলে আসে হেফাজতে ইসলাম। নির্বাচন বা জোট ইস্যুতে এখনো তাদের সাংগঠনিক কোনো তৎপরতা নেই। অরাজনৈতিক সংগঠন হওয়ায় এর ব্যানারে কোনো নেতার নির্বাচনে অংশগ্রহণেরও সুযোগ নেই। তবে অন্য কোনো ইসলামি দল থেকে হেফাজতের কোনো নেতার প্রার্থী হতেও বাধা নেই। তবে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ বা ইসলামী ঐক্যজোট ছাড়া অন্য কোনো দল থেকে কেউ প্রার্থী হলে সংগঠনটির সমর্থন মিলবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী সারাবাংলাকে বলেন, ‘হেফাজত ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এর ব্যানারে কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তবে হেফাজত ইসলামের সঙ্গে যুক্ত কেউ অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নির্বাচন করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে হেফাজত ইসলামের পরিচয় দিতে পারবেন না।’
নির্বাচন সামনে রেখে ইসলামী দলগুলোর জোটের বিষয়ে মওলানা মহিউদ্দিন বলেন, ‘ইসলামি সমমনা দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, এ তথ্য শুনেছি। দেশে যদি ইসলামি দলগুলোর ঐক্য হয় এবং ইসলামি সরকার ও শাসনব্যবস্থা চালু হয়, তাহলে সেখানে হেফাজত ইসলাম সমর্থন জানাবে।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর
ইসলামি জোট ইসলামি দল ইসলামী আন্দোলন জাতীয় নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচন জামায়াতে ইসলামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হেফাজতে ইসলাম