ভোটের মাঠে ‘স্বাধীন’ জাতীয় পার্টি
১৬ নভেম্বর ২০২৪ ২২:৩৪
ঢাকা: ’৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর থেকেই জাতীয় পার্টি (জাপা) ঠিক মতো উঠে দাঁড়াতে পারেনি। এমনকি নিজেদের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর সাহসও তারা কোনোদিন দেখায়নি। বলতে গেলে ক্ষমতার পালাবদলে জাপা সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্রীড়ানক হিসেবে কাজে লেগেছে। সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই দলটি হয় আওয়ামী লীগ, নয়তো বিএনপি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। আর এর মধ্য দিয়ে দলটি প্রায় সবসময়ই ক্ষমতার বলয়ে অবস্থান করেছে।
গত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন জাতীয় সংসদের সাবেক বিরোধীদল জাতীয় পার্টি স্বাধীনভাবে রাজনীতি করতে পারেনি। অভিযোগ রয়েছে, জাপার দলীয় সিদ্ধান্তসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতো আওয়ামী লীগ। এমনকি জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যও সংসদ নেতাকে দেখিয়ে তারপর উপস্থাপন করা হতো। জাপা যাদের-ই ক্রীড়ানক হিসেবে কাজে লেগেছে তারাই দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে রেখেছে। কখনো কখনো আবার পার্টিতে ভাঙন তৈরি করে দিয়েছে। সেই ভাঙনের ফলে জাতীয় পার্টি এখন চারটি।
সর্বশেষ, বেগম রওশন এরশাদকে দিয়ে ছায়া জাতীয় পার্টি করে রেখেছিল আওয়ামী লীগ। এক পর্যায়ে রওশনও প্রকাশ্যে জাতীয় পার্টির তার বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু জাপার সর্বময় ক্ষমতা এখন গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের হাতে। এভাবেই দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব-সংঘাতে চলছে জাতীয় পার্টি। যে কারণে গত ১৫ বছর জাপা ভোটের মাঠে তাদের নিজস্ব শক্তি দেখাতে পারেনি। ফলে জাতীয় পার্টি তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি বলে জানিয়েছে দলটির শীর্ষ নেতারা।
এদিকে, জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে জাতীয় পার্টি পূর্ণ সমর্থন দেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাপাও অন্তর্বর্তী সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় পরামর্শের জন্য সেনাবাহিনীর ডাক পায়। কিন্তু গত ১৫ বছর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্রীড়ানক হিসেবে কাজ করা জাপা ধীরে ধীরে সেই জায়গা হারিয়ে ফেলে। ফলে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকেও তাদের ডাকা হয় না। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে তাদের রাজনীতিও নিষিদ্ধ চায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন। এতে জাপার সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি। সেই দূরত্ব এখনো ঘোচেনি। এরই মধ্যে তারা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দল গোছাতে মাঠে নেমেছে।
দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জাপা আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হয়ে এসেছে। এখন তারা দেশ গড়ার ক্ষেত্রে ও রাজনীতিতে তরুণ প্রজন্মের চেতনার প্রতিফলন ঘটাতে এবং দলকে সুসংগঠিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। জানা গেছে, নিজেদের সুসংগঠিত করতে জাপা পার্টি থেকে চলে যাওয়া কিছু ব্যক্তিকে ফের দলে ফিরিয়ে নিতে পারে। তবে ঘোষণা দিয়ে দলছুট সকল নেতাকর্মীকে মূল দলের সঙ্গে একীভূত করা হবে না।
সূত্র বলছে, গত প্রেসিডিয়াম বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভাগীয় শহরে অতিরিক্ত মহাসচিবরা সফর করবেন। এ সময় তারা জাতীয় পার্টিকে সুসংগঠিত করতে বর্ধিত সভাসহ নির্বাচনকে ঘিরে সম্ভাব্য প্রার্থীদেরও খুঁজে নেবে। এ সময় তারা প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইবে।
জানা গেছে, এখন তারা নিজেদের সাংগঠনিক শক্তিমত্তা দিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের আনুষ্ঠানিকভাবে নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় পার্টিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে জনগণের মাঝে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশদের নয় বছরের শাসনামলের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম তুলে ধরার জন্য বলা হয়েছে।
জাতীয় পার্টির নীতি নির্ধারকদের লক্ষ্য, আগামী নির্বাচনে তারা এককভাবে নির্বাচন করবে। শীর্ষ নেতাদের দাবি, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করা হলে জাপা একক শক্তিতে ভোটের মাঠে সাড়া জাগাবে। তারা সংসদের প্রধান বিরোধীদলও হতে পারবে।
এসব বিষয়ে কথা হয় জাতীয় পার্টির মহাসচিব অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নুর সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর তরুণদের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে জনগণের আকাঙ্ক্ষা মিলিয়ে জাপা তার রাজনীতি ঠিক করছে। সেইসঙ্গে দলকে সুসংগঠিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বাছাই করা নেওয়া হবে।’
দলটির অপর এক প্রেসিডিয়াম সদস্য সারাবাংলাকে, ‘৯০ সালে এরশাদ সাহেবের পতনের পর ৩৫টি আসন পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সরকার গঠনে অন্য দলকে সাহায্য করতে ট্রাম্প কার্ড হবে।’
এদিকে, জাপার ঘাঁটি বৃহত্তর রংপুরের ৪৬টি আসনের মধ্যে ২০টি আসনে তাদের প্রার্থী জিতিয়ে আনার টার্গেট করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রংপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মো. মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বৃহত্তর রংপুরের সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা চূড়ান্ত হয়নি। তবে শিগগিরই হয়ে যাবে। জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করার জন্য বড় একটি শোডাউন হবে ডিসেম্বরের প্রথমে অথবা শেষের দিকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় পার্টি এখন রাহুমুক্ত। আগের তুলনায় জাতীয় পার্টি রংপুরে সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী। বিগত দিনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’ তিনি জানান, বৃহত্তর রংপুরে সম্ভাব্য প্রার্থীদের গণসংযোগ চলছে। ফেয়ার নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টি রংপুরে ২০টি আসনে জয়লাভ করতে পারে।
দিনাজপুর জাতীয় পার্টির সভাপতি দিলার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘জেলা পরিষদ নির্বাচনে আমি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেছি। ফলে জাতীয় পার্টিতে নিয়ম অনুসারে আমার থাকার কথা নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পার্টি থেকে পদত্যাগও করেনি। তবে ফেয়ার নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও তরুণ সমাজের প্রত্যাশার ভিত্তিতে দলীয় রাজনীতি কার্যক্রম করলে দিনাজপুরের আসনগুলোতে জয়লাভ করতে পারে।’
ঠাকুরগাঁও জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রহমান স্বপন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঠাকুরগাঁও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো আতঙ্ক নেই। আমাদের দল এখন নিজস্ব রাজনীতি নিয়ে জনগণের কাছে যেতে পারছে। অতীতে আমাদের এই পথ বন্ধ ছিল। এখন জনগণের কাছে যাওয়া হচ্ছে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টির মধ্যে গ্রুপিং বন্ধ হলে ঠাকুরগাঁও জাতীয় পার্টি অনেক শক্তিশালী হবে।’
সাতক্ষীরা জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. আশরাফুজ্জামান আশু বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পক্ষে আমরা ছিলাম। জাতীয় সংসদে আমাদের দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের তাদের পক্ষে একাধিকবার বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ করে আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের রোষানালে পড়েছি।’
তিনি বলেন, ‘একদম ফেয়ার নির্বাচন হলে সাতক্ষীরা চারটি আসনের মধ্যে আমরা দুটি আসন নিশ্চিত পাব। সাতক্ষীরায় জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা খুবই ভালো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা জাতীয় পার্টির সাত/আট জনের নামে হয়রানিমূলক মামলা দিয়েছে। তারপরও আমরা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।’
খুলনা জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির ভাই চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম মধু সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির কার্যক্রম খুলনা বিভাগে বিভিন্ন জেলায় চলছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের আসনগুলোতে গণসংযোগ ও ঘরোয়া বৈঠকের মতো কার্যক্রমগুলো চালিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ১৫ বছর জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের বি-টিম হওয়ার কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রমসহ গণসংযোগ ব্যাহত হচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব ও ভয়-ভীতি না থাকলে খুলনা বিভাগের ৩৬টি আসনের মধ্যে চার/পাঁচটি আসনে জাতীয় পার্টি পেতে পারে।’ মধু বলেন, ‘আওয়ামী লীগসহ সরকারি নানা সংস্থার প্রভাবের কারণে আমি নিজেই ভোটের মাঠে তৎপর ছিলাম না। আগামী নির্বাচনে কতটুকু প্রভাব মুক্ত থাকতে পারব সেটাই এখন প্রশ্ন।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম