‘মেয়েকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল, বাসচালকদের প্রতিযোগিতায় সব শেষ’
১৭ নভেম্বর ২০২৪ ২১:২১
ঢাকা: রাজধানীর বাড্ডায় অবস্থিত নেক্সট ভেঞ্চার নামে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন তাসনিম জাহান (আইরিন)। সিলেট শাহজাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে কিছুদিন আগে ঢাকায় এসে প্রতিষ্ঠানটিতে যোগ দেন আইরিন (২৪)।
গত ৯ অক্টোবর অন্যান্য দিনের মতো করেই বড় বোন নুসরাত জাহানের (২৮) সঙ্গে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন তিনি। সকাল সোয়া ৯টার দিকে মধ্য বাড্ডায় প্রগতি সরণি পার হচ্ছিলেন। তবে সেই সড়ক আর পার হওয়া হয়নি আইরিনের, পৌঁছাতে পারেননি অফিসেও। আকাশ পরিবহনের দুটি বাসের চালকদের গতি প্রতিযোগিতার শিকার হন আইরিন ও তার বোন নুসরাত। বাসের ধাক্কায় দুর্ঘটনাস্থলেই আইরিন প্রাণ হারান। বড় বোন নুসরাতকে গুরুতর আহত অবস্থায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আদরের মেয়েকে হারিয়ে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি তাসনিম জাহান আইরিনের পিতা সাইফুল আলম। তিনি বলেন, ‘রোডক্র্যাশে আমার সাজানো-গোছানো পরিবারকে ভয়ংকর ট্রমার দিকে নিয়ে গেছে। বাসচালদের প্রতিযোগিতার বলি হয়ে আমার মেয়েকে অকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। অথচ তাকে নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন ছিল! এক নিমেষে সব শেষ।’
সাইফুল আলম আরও বলেন, ‘বাসচালকদের বেপরোয়া গতি প্রতিযোগিতার কারণেই ঢাকা শহরে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। তাই দুর্ঘটনা বন্ধে জরুরিভাবে এমন পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন যেন বাসচালকরা এ ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হন।’
রোববার (১৭ নভেম্বর) ‘ওয়ার্ল্ড ডে অব রিমেমবারেন্স ফর রোড ট্রাফিক ভিক্টিমস’ উপলক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় নিজের মেয়েকে হারানোর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরছিলেন সাইফুল ইসলাম। আগের বছরগুলোর মতোই সড়কে প্রাণ হারানো মানুষদের স্মরণে আয়োজনটি করে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ।
এ বছর ‘ওয়ার্ল্ড ডে অব রিমেমব্রেন্স ফর রোড ট্রাফিক ভিক্টিমস’ দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘Remember. Support. Act’, অর্থাৎ ‘আমরা স্মরণ করি যারা রোডক্র্যাশে মারা গেছেন তাদের, সহায়তা নিয়ে থাকতে চাই আহতদের পাশে এবং জীবন বাঁচাতে নিতে চাই কার্যকর উদ্যোগ’।
সভায় বক্তারা বলেন, বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন এক হাজারের বেশি শিশু এবং ৩০ বছরের কম বয়সী তরুণ-তরুণী রোড ক্র্যাশে মারা যায়। বাংলাদেশে এই সংখ্যা প্রতিদিন প্রায় ১৪ জন। অথচ এই মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। জাতিসংঘ নির্ধারিত নিরাপত্তা কৌশল অনুসরণ করে এই মৃত্যু কমানো সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন কার্যকর সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন।
বক্তারা আরও বলেন, বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকার বিভিন্ন খাতের সংস্কার আনার পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে। আমাদের দাবি, সড়ক নিরাপত্তার সংস্কার ভাবনায় সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করতে হবে।
অতিথির বক্তব্যে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক খন্দকার আব্দুল আউয়াল রিজভী বলেন, ‘আমাদের দেশে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। সংখ্যা যাই হোক না কেন, সড়কে প্রাণহানি ঘটছে— এটি ধ্রুব সত্য। অথচ এই মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। তাই উন্নত দেশের মতো জাতিসংঘ স্বীকৃত নিরাপত্তা কৌশল অনুসরণ করে সড়ক নিরাপত্তা আইন করা প্রয়োজন।’
গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের ইন-কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর ড. শরিফুল আলম বলেন, ‘সমস্যার প্রকৃত সমাধান করতে হলে বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে হলে প্রথমেই সড়কে প্রাণহানির প্রকৃত সংখ্যা উদ্ঘাটন করতে হবে।’ সড়ককে নিরাপদ করতে আলাদা করে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা জরুরি বলে মত দেন তিনিও।
সভাপতির বক্তব্যে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন বলেন, ‘সড়ককে নিরাপদ করতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে। বর্তমান সংস্কার ভাবনায় পৃথক সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের ব্যাপারে বিআরটিএ’র ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।’
মতবিনিময় সভায় প্রতিপাদ্য বিষয়ের ওপর মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোড সেফটি অ্যান্ড ইনজুরি প্রিভেনশন প্রোগ্রামের ম্যানেজার মোহাম্মদ ওয়ালী নোমান।
মতবিনিময় সভায় হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ইকবাল হোসাইন, বিআরটিএর রোড সেফটি পরিচলাক গোলাম মাহবুব ই রাব্বানি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী, রোড সেফটি অ্যান্ড ইনজুরি প্রিভেনশন প্রোগ্রামের পরিচালক ডা. মাহফুজুর রহমান ভুঁইয়া, ডা. আহমেদ খাইরুল আবরার, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি, বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির প্রতিনিধি, বাংলাদেশ রোড সেফটি কোয়ালিশনের সদস্য ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
সারাবাংলা/এসবি/এইচআই
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট রোডক্র্যাশ সড়ক দুর্ঘটনা