চাঁদরাতের অপেক্ষায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা
১৩ জুন ২০১৮ ০৯:৪৬
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চাঁদরাত মানে ঈদুল ফিতরের আগের রাত কিংবা রমজানের শেষদিন। আকাশে যখন প্রতীক্ষার চাঁদের দেখা মেলে, তখন ঘরে ঘরে শুরু হয় ঈদের খুশির বন্যা। শুরু হয় ঈদ আনন্দের প্রস্তুতি। তবে চট্টগ্রামে চাঁদরাতের বিশেষত্ব অন্যরকম।
চাঁদরাতে ঈদের কেনাকাটা চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে প্রচলিত রীতি। সময়ের ব্যবধানে চট্টগ্রামের পুরনো বাসিন্দাদের মধ্যে এটা ঐতিহ্য হয়ে গেছে। তাই প্রতিবছর চাঁদরাতে চট্টগ্রাম নগরী এমনকি শহরের উপকন্ঠের মার্কেটগুলোতেও মানুষের ঢল নামে। রাতভর চলে কেনাকাটার ধুম।
চাঁদরাতের ঐতিহ্য নিয়ে ইতিহাসবিদ শামসুল হোসাইন বলেন, আগেকার দিনে চট্টগ্রামের সওদাগর পরিবারে রেওয়াজ ছিল চাঁদরাতে কেনাকাটা করা। পুরো রমজান মাস ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আর চাঁদরাতে ঈদের বাজার করতেন। পরে এটা সবার কাছেই রেওয়াজে পরিণত হয়।
ব্যবসায়ীদের মতে, ১৫ রমজানের পর থেকে মার্কেট-শপিংমলে ক্রেতার ভিড় বাড়ে। তবে এসব ক্রেতার অধিকাংশই শহরের বাইরের। যারা গ্রামগঞ্জে কিংবা চট্টগ্রামের বাইরের জেলায় ঈদ করেন তারাই থাকেন ১৫ রোজার পরের দিনগুলোর ক্রেতা। যারা চট্টগ্রামের স্থায়ী কিংবা আদি বাসিন্দা তাদের কেনাকাটার সময় চাঁদরাত।
ব্যবসায়ীদের হিসেবে, চাঁদরাতের এক রাতেই চট্টগ্রামের মার্কেট-শপিংমলে কয়েক’শ কোটি টাকার ব্যবসা হয় যা পুরো রমজানের ব্যবসার প্রায় কাছাকাছি। প্রতি বছরের মতো এবারও চাঁদরাতের জমজমাট বিক্রির অপেক্ষায় আছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম নগরীর মার্কেট-শপিংমলগুলোতে ১৫ রোজার পর থেকে যথারীতি ক্রেতার ভিড় শুরু হয়েছিল। তবে গত তিনদিনের (রবি, সোম ও মঙ্গলবার) প্রবল বর্ষণের কারণে ভাটা পড়েছিল। মঙ্গলবার (১২ জুন) সন্ধ্যার পর থেকে আবহাওয়া শান্ত আছে। বৃষ্টির প্রতাপ নেই। এর ফলে সন্ধ্যার পর থেকে মার্কেট-শপিংমলে আবারও শুরু হয়েছে ক্রেতার আনাগোণা।
নগরীর টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহমদ হোছাইন সারাবাংলাকে বলেন, বৃষ্টির কারণে গত দুইদিন ধরে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারেনি। বিক্রিও হয়নি। আজ (মঙ্গলবার) বৃষ্টি কমে আসায় মানুষ বের হচ্ছেন। তবে মূল কেনাবেচা হবে চাঁদরাতে। আমরা সেইদিনের অপেক্ষায় আছি।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ১৫টি অভিজাত ও ৫৮টি সাধারণ বিপণিকেন্দ্র আছে। এ ছাড়া টেরিবাজার, তামাককুন্ডী লেইন ও রিয়াজউদ্দিন বাজারে ২৬০টি ছোট আকারের মার্কেট আছে।
নগরীর নিউমার্কেট, মিমি সুপার মার্কেট, স্যানমার ওশান সিটি, আমিন সেন্টার, ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্স, সেন্ট্রাল প্লাজা, শপিং কমপ্লেক্স, ইউনেস্কো সেন্টার, আখতারুজ্জামান সেন্টার, ব্যাঙ্কক-সিঙ্গাপুর মার্কেট, লাকী প্লাজা, ভিআইপি টাওয়ার, রেয়াজউদ্দিন বাজার, বে-শপিং সেন্টার, অলঙ্কার কমপ্লেক্স, জহুর হকার্স মার্কেট, সমবায় সিঙ্গাপুর মার্কেটসহ সবখানেই এখন জমজমাট ঈদবাজার।
জহুর হকার্স মার্কেট, তামাকমুণ্ডি লেইন, রিয়াজউদ্দিন বাজারে লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি। বৃষ্টির আগে সেখানে এতই লোকসমাগম ছিল যে হাঁটাচলাও অনেক কষ্টকর। লোকে লোকারণ্য ফুটপাতের বাজারগুলোও। শার্ট, প্যান্ট, শাড়ি, সেলোয়ার-কামিজ, প্রসাধনী সবকিছুই মিলছে ফুটপাতে।
তবে এত বিক্রির ভিড়েও চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত বিপণী বিতান থেকে শুরু করে ফুটপাতের দোকানীর পর্যন্ত অপেক্ষা চাঁদরাতের জন্য।
নগরীর আমতল থেকে নিউমার্কেট এলাকায় ঘুরে ঘুরে টুপি, রুমাল বিক্রি করেন কুমিল্লার মুরাদনগরের হোসেন মিয়া। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, চাঁদরাতে সারারাত জেগে থাকবে। সবাই পরের দিনের জন্য নতুন টুপি-রুমাল কিনেন। এই এক রাতের বিক্রি পুরো রমজানেও হয় না।
রিয়াজউদ্দিন বাজারের ছবি ক্লথ স্টোরের মালিক মো.আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন-চট্টগ্রাম শহরের যারা স্থায়ী বাসিন্দা কিংবা শহরের কাছে যাদের বাড়ি তারা সাধারণত ঈদ করতে শহর ছেড়ে যান না। এরকম লাখ লাখ মানুষ আছে। এরা চাঁদ দেখা যাওয়ার পরই কাপড়চোপড় কিনতে বের হবেন। নগরীর আন্দরকিল্লা, এনায়েতবাজার, লালখানবাজার, ফিরিঙ্গিবাজার, চন্দনপুরা, বাকলিয়া, হালিশহর, আগ্রাবাদ, পতেঙ্গা, আলকরণ এলাকা থেকে লোকজন চাঁদরাতে মার্কেটে আসে। তাদের জন্য আমরা ফজরের আযান পর্যন্ত দোকান খোলা রাখি।
টেরিবাজারের বিনয় ফ্যাশনের মালিক রাশেদুল করিম সারাবাংলাকে বলেন, আমরা যারা ব্যবসায়ী এবং আমাদের স্টাফরা প্রায় সবাই চাঁদরাতেই নিজেদের পোশাক কিনি। রমজানের শেষদিকে স্টাফদের বেতন-বোনাস দেওয়া হয়। চাঁদরাতে পোশাক কিনে পরদিন তারা বাড়ি চলে যান।
নগরীর নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা আলকরণ এলাকার গৃহবধূ নাজিয়া আক্তার টুম্পা সারাবাংলাকে বলেন, ১৫ রোজার আগে ঘরের আসবাবপত্র কিনেছি। ১৫ রোজার পর থেকে বাচ্চাদের কাপড়চোপড় কিনছি। উপহার যেগুলো দেব সেগুলোও কিনে শেষ করছি। আমরা বড়দের কাপড় কেনার জন্য চাঁদরাত পর্যন্ত সময় আছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরে দেখা গেছে, শাড়ির মধ্যে সুতি, টাঙ্গাইলের জামদানি, কাতান, বালুচরি, হাফ সিল্ক বেশি বিক্রি হচ্ছে। নারীদের মধ্যে গাউন পোশাক কেনার আগ্রহ বেশি। সাথে আছে জুয়েলারি সেট ও বিদেশি লেডিস ব্যাগ।
নগরীর কাজীর দেউড়ি থেকে আফমি প্লাজায় কেনাকাটা করতে যাওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী লতিফা আনসারি রুনা সারাবাংলাকে বলেন, এবার পাকিস্তানি লুমের মধ্যে বুটিকের কাজ করা কামিজ, প্লাজু-শর্ট কামিজ আর গাউন বেশি চলছে। ভারতের জামা চলছে না। কারণে সেগুলো ধোয়ার পর রঙ চলে যায়, সংকুচিত হয়ে যায়। সেজন্য পাকিস্তানি লুম আর গাউনের চাহিদা বেশি।
আর পুরুষের কেনাকাটার তালিকায় যথারীতি আছে পাঞ্জাবি। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের শৈল্পিক, খাদিঘরসহ পাঞ্জাবির বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকানে ভিড় দেখা গেছে।
তবে ছেলেদের পোশাকের মধ্যে ক্যাজুয়াল শার্ট, অফিসিয়াল শার্ট, জিন্স, গ্যাবাডিন, ফর্মাল প্যান্টও বিক্রি হচ্ছে বেশ।
নিউমার্কেটের ছেলেদের পোশাকের ব্র্যান্ড ফ্যাশন প্রতিষ্ঠান ম্যানহুড’র স্বত্তাধিকারী জিকু সারাবাংলাকে জানান, নামীদামী ফ্যাশনের পোশাকের চেয়েও নিজস্ব ডিজাইনের পোশাকের প্রতি এবার ছেলেদের বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
সাধারণ ছাপা লুঙ্গি, নকশা করা লুঙ্গিও বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন টেরিবাজার ও রিয়াজউদ্দিন বাজারের বিক্রেতারা।
সারাবাংলা/আরডি/এমএইচ