Tuesday 03 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডেঙ্গু আক্রান্ত ৩১% রোগীর নমুনা পরীক্ষা ফলস নেগেটিভ: গবেষণা

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:১১ | আপডেট: ৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:৪০

ডেঙ্গু। ফাইল ছবি

ঢাকা: দেশে সরকার নির্ধারিত মূল্যে ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। ডেঙ্গু রোগের উপসর্গ দেখা দেওয়ার প্রথম দুই থেকে পাঁচ দিনের মাঝে নমুনা পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। এমনই ২০০ নমুনা তিন পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হয়েছে একটি গবেষণার জন্য। সারাদেশে ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য পরিচিত এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিতে পরীক্ষার পাশাপাশি আরটি-পিসিআর ও এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে এই নমুনা পরীক্ষা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

এতে দেখা গেছে, আরটি-পিসিআর ও এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে ১২৪ জনের ডেঙ্গু সংক্রমণ নিশ্চিত হলেও এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিতে ৯৩ জনের ডেঙ্গু সংক্রমণ শনাক্ত হয়। অর্থাৎ অন্য দুই পদ্ধতিতে ডেঙ্গু সংক্রমণ শনাক্ত হলেও এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিতে সেটা ধরা পড়েনি। অর্থাৎ প্রায় ৩০ দশমিক ৬৪ শতাংশ নমুনা পরীক্ষার ফলাফল ফলস নেগেটিভ, যা অন্য পদ্ধতির পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছে।

গবেষকরা বলছেন, বর্তমানে সারাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করানো হয়ে থাকে। ডেঙ্গুর সেরোটাইপ পরিবর্তনসহ কিটের সেনসিভিটি, স্পেসিফিটির মানসহ বিভিন্ন কারণে এই পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসতে পারে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সকল উপসর্গ থাকার পরেও নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ হওয়ার কারণে ডেঙ্গু নেই ভেবে অনেকে আতঙ্কমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রোগীর শারীরিক পরিস্থিতি হঠাৎ খারাপ হওয়া হতে শুরু করে। আর দেরিতে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কারণে প্রাণহানির ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

দেশের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের (নিলমারসি) ভাইরোলজি বিভাগের করা এক গবেষণা থেকে এমন তথ্য জানা গেছে।

গবেষণার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের ডেঙ্গু শনাক্তকরণের জন্য নমুনা পরীক্ষা করাতে আসে। এর মাঝে ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে জমা দেওয়া দৈবচয়নের ভিত্তিতে ২০০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয় গবেষণার জন্য। এই নমুনাগুলো জ্বরের প্রথম এক থেকে পাঁচ দিনের মাঝেই সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মে মাস অর্থাৎ সাত মাস সময় এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

গবেষকরা জানান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের ভাইরোলজি বিভাগের ল্যাবে এই ২০০ নমুনা পরীক্ষা করা হয় তিনটি পদ্ধতিতে। দেশে সাধারণভাবে ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য প্রাথমিকভাবে এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি এনএসওয়ান-এলাইজা ও পিসিআরেও এই নমুনা পরীক্ষা করা হয়।

গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, এই ২০০ নমুনার মাঝে ১২৪ জনের ডেঙ্গু সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এই নমুনাগুলো পিসিআর ও এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে সংক্রমণ শনাক্ত নিশ্চিত হওয়া যায়৷ তবে এই ১২৪ নমুনায় সংক্রমণ শনাক্ত হলেও এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিতে ৯৩ জনের ডেঙ্গু নেগেটিভ ফলাফল দেখা যায়।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান ডা. আরিফা আকরাম এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন। এই গবেষণায় সহযোগী গবেষক হিসেবে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. তানিয়া ইসলাম রেশমা ও প্রতিষ্ঠানটির ভাইরোলজি বিভাগের মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. তাসনিম নাফিসা।

গবেষণা বিষয়ে ডা. আরিফা আকরাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু সংক্রমণ শনাক্তের জন্য সারাদেশে উপজেলা পর্যায়েও বর্তমানে এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। যেখানে বেশি মানুষের নমুনা পরীক্ষা করাতে হবে সেখানে সুলভ মূল্যে এই পদ্ধতিতেই পরীক্ষা করানোটা সুবিধাজনক।’

তিনি বলেন, ‘তবে এই পদ্ধতিতে গত বছরের নমুনায় ফলস নেগেটিভ দেখেছি। এটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। নমুনা পরীক্ষায় ফলস নেগেটিভ মানে রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত না— বিষয়টা কিন্তু তেমনও না। এক্ষেত্রে এনএসওয়ান-এলাইজা বা পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করানো হলে রোগ শনাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যেহেতু পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা ব্যয়বহুল, তাই আমরা এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেনসিভিটি ও স্পেসিফিটি বিবেচনায় আমরা ডেঙ্গু শনাক্তে এনএসওয়ান- আইসিটির চাইতে এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে ভালো ফলাফল পেয়েছি। যেহেতু গতবছর ফলস নেগেটিভ কেইস পাওয়া গেছে, তাই সেটার সমাধান হিসেবেও আমরা বর্তমানে এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করাতে পারি।’

ডা. আরিফা বলেন, ‘ডেঙ্গুর চিকিৎসা কিন্তু সিম্পটমেটিক হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে অনেক সময় সিবিসি পরীক্ষায়ও কিন্তু ডেঙ্গু নিশ্চিত হয়ে উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু তারপরেও অনেকে কিন্তু নমুনা পরীক্ষার ফলাফলেই নিশ্চিত হতে চান। সেক্ষেত্রে আমরা এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতির নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ এলে এনএসওয়ান-এলাইজা নমুনা পরীক্ষা করানোর পক্ষে। কারণ মূল্য বিবেচনায় এটি পিসিআরের তুলনায়ও অনেক সাশ্রয়ী।’

তিনি বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায় ডেঙ্গু ফলস নেগেটিভ রিপোর্ট পেয়ে রিল্যাক্স মুডে জ্বর নিয়েও কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করে। পরবর্তী সময়ে যখন হাসপাতালে যাচ্ছেন তখন তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। এক্ষেত্রে ডেঙ্গু রোগের উপসর্গ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে এনএসওয়ান-আইসিটি পদ্ধতির পরীক্ষায় নেগেটিভ ফলাফল এলেও এনএসওয়ান-এলাইজা নমুনা পরীক্ষা করালে ডেঙ্গু সংক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে।’

এনএসওয়ান-এলাইজা পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টা এমন না যে এটা নতুন কিছু, যার জন্য বিদেশ থেকে মেশিন আনতে হবে। জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিন্তু এই মেশিন আছে, যা দিয়ে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা করানো হয়ে থাকে।’

ডা. আরিফা আকরাম বলেন, ‘আমাদের উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সগুলোতে সিবিসি, ইএসআর মেশিন আছে। এক্ষেত্রে আমরা যদি সরকারকে বোঝাতে পারি যে এলাইজা পদ্ধতিতে স্বল্প খরচে বেটার ফলাফল আসে, তবে অবশ্যই সেই সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সরকারিভাবে এলাইজা মেশিন সরবরাহ করা যেতে পারে।’

বিভিন্ন পদ্ধতির মূল্য বিষয়ে ধারণা দিয়ে ডা. আরিফা বলেন, ‘এনএস১ আইসিটি পরীক্ষার খরচ ৫০ টাকা। কিন্তু এই পরীক্ষায় অনেক বেশি ফলস নেগেটিভ হতে দেখা গেছে। এর অর্থ ডেঙ্গু আছে, কিন্তু পরীক্ষায় তা ধরা পড়ে না। আরটি-পিসিআর পরীক্ষা নির্ভরযোগ্য, কিন্তু প্রতিটি পরীক্ষায় খরচ পড়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা। অন্যদিকে, এনএস১ এলাইজা পরীক্ষায় শনাক্ত সঠিক হয়, খরচ চারশ’ টাকার মতো।’

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জনস্বাস্থ্যবিদ মোহাম্মদ মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের সব এলাকায় এনএসওয়ান-এলাইজা পরীক্ষার ব্যবস্থা সরকারের করা উচিত এবং পরীক্ষায় সরকারের ভর্তুকি দেওয়া উচিত। খরচের কথা সরকারের ভাবা উচিত নয়। আক্রান্ত ব্যক্তির ও মৃত্যুর ক্ষতি বিবেচনায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি বেশি হওয়ার কথা নয়।’

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ ইউসুফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এনএস-ওয়ান আইসিটি পরীক্ষায় সহজে ও অল্প সময়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা যায়। তবে এই পদ্ধতিতে অনেক সময় ভুল রিপোর্টও পাওয়া যায়, বা শনাক্ত হয় না। ফলে সংক্রমণ শনাক্ত না হওয়ায় অনেকেই চিকিৎসাসেবার আওতায় আসতে চান না। এতে চিকিৎসা দেরিতে শুরু হয়। ফলে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে।’

উল্লেখ্য, স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্ল্যানিং, মনিটরিং অ্যান্ড রিসার্চ অপারেশনাল ফান্ডের (পিএমআর) তত্ত্বাবধানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের (নিলমারসি) ভাইরোলজি বিভাগের ডেঙ্গুবিষয়ক এই গবেষণাটি করা হয়।

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

৩১ শতাংশ গবেষণা ডেঙ্গু নেগেটিভ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর