এক বিজয় করেছ, আরেক বিজয় আসবে— শিক্ষার্থীদের প্রধান উপদেষ্টা
৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ০০:২১ | আপডেট: ৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৪৪
ঢাকা: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মত বিনিময় করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা সরকার প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীদের মনোভাব জানতে চান। সরকারকে শিক্ষার্থীরা কোনো পরামর্শ দিতে চান কি না, সেটিও জিজ্ঞাসা করেন।
শিক্ষার্থীরাও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, জুলাই গণআন্দোলনে নিহতদের খেতাব দেওয়া ও আহতদের সুচিকিৎসায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়াসহ নানা বিষয়ে নিজেদের অভিমত তুলে ধরেন। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অভিমত ও উদ্বেগগুলোর প্রশংসা করেন।
প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘আলাদা আলাদা করে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে আগে দেখা হয়েছে। আজ অনেকের সঙ্গে একবারে দেখা হলো। ভালো হলো। তোমাদের কথা শুনতেই মূলত আজকে বসা। তোমরা সরকারের কাছে কী চাও, সরকারের কাছে প্রত্যাশাগুলো কী, কোনো পরামর্শ আছে কি না— এগুলোই জানতে চাওয়া।’
শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রের অভিভাবক অভিহিত করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘তোমরা রাষ্ট্রের অভিভাবক। তোমাদের কারণেই রাষ্ট্র। নিজেদের এই ভূমিকা ভুলে যেও না। অনেকে এখানে আছে, অনেকে নেই। যারা নেই, তারাও রাষ্ট্রের অভিভাবক। রাষ্ট্র যেন ঠিক পথে চলে, যেন বিচ্যুত না হয়, এটা দেখা তোমাদের দায়িত্ব। এটুকু মনে রাখলেই রাষ্ট্র ঠিক থাকবে। নিজের অভিভাবকত্ব ভুলে যেও না।’
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরামর্শকে স্বাগত জানান প্রধান উপদেষ্টা। বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য ঠিক থাকতে হবে। সিন্ডিকেট নাকি কী, এ ধরনের ব্যাখ্যা আমরা চাই না। কতগুলো লোক বাজারমূল্য কবজা করে থাকবে, সেটা হতে পারে না। আমরা চেষ্টা করছি দ্রব্যমূল্য ঠিক রাখার। আমরা দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল (স্ট্যাবল) রাখতে চাই। রমজানেও দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হবে। হঠাৎ করে যেন কোনো পরিস্থিতি না হয়।’
স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার পরামর্শে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘স্থানীয় সরকার সংস্কারের জন্য কমিশন আছে। তারা পরামর্শ দেবে, আমরা কাজ করব। আমরা চাই, স্থানীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হোক। খুব কম জিনিস উচ্চ পর্যায়ে থাকবে। দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেম, একবার একটা ফান্ড বানিয়ে দিলে কারা যেন খেয়ে ফেলে। সে জন্য সুশৃঙ্খলভাবে সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে, যেন স্থায়ী হয়।’
জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলনে নিহতদের রাষ্ট্রীয় সম্মান ও খেতাবের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। জুলাইয়ে যারা শহিদ হয়েছে তাদের অবদান আমরা ভুলব না। তাদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হবে।’
মতবিনিময়ের সময় শিক্ষার্থীরা শিক্ষা খাতের সংস্কারে বিশেষ জোর দেওয়ার কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। যেন বাংলাদেশে কেউ শিক্ষিত না হয়ে উঠতে পারে, দক্ষ হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য পরিকল্পিতভাবে এটা হয়েছে। বেকারত্ব তৈরি করা হয়েছে। উদ্যোক্তাদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক কিছু নেই। এটা আমদের ঠিক করতে হবে। তরুণদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।’
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসনের ব্যবস্থা করার পরামর্শও দেন শিক্ষার্থীরা। ড. ইউনূস এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, আমাদের অর্থনীতি বিভাগে নারী শিক্ষার্থী ছিল মাত্র চারজন। তোমরা বলছ, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থী প্রায় ৫২ শতাংশ। এটি অত্যন্ত আনন্দের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে আগে সিট বণ্টন হতো, সেই দাসপ্রথা এখন ভেঙে গেছে। শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।’
মতবিনিময়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বারবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও গণমাধ্যমে সরকারের কাজ সঠিকভাবে প্রচার না করার বিষয়টি তুলে ধরাত হয়। শিক্ষার্থীদের এমন বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা বলে তারা সরকারের বিরুদ্ধে সরব, এটা ঠিক। সরকারের নিজের কোনো পত্রিকা নেই। আছে শুধু প্রেসউইং। তারা পত্রিকায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠায়। কেউ ছাপে, কেউ ছাপে না। কিংবা তাদের মনমতো শেষ পাতায় বা কোণায় ছোট করে দেয়। প্রেসউইং ওদের মতো করে চেষ্টা করছে, কাজ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার কোনো গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করবে না। সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে কাজ করবে। এটাই আমাদের নীতি। আমরা এই নীতিতে থাকব। আমি বুঝতে পারছি, তোমরা কিছুটা মনক্ষুণ্ণ। এটা আসলে কিছুটা মন খারাপ হওয়ার মতোই যে সরকারের কাজ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পুরো সিস্টেমটাই ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। চারদিকে চুরি-চামারি, ব্যাংক কাজ করে না। কমিটি অর্থনীতির শ্বেতপত্র দিয়েছে। আমি বলেছি, এটি ঐতিহাসিক দলিল। আমি মনে করি, এটি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো উচিত। দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার দায় আওয়ামী লীগের। তবে যারা উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে বলে ঘোষণা দিয়েছে, তাদের ধরতে হবে। যে ধ্বংসস্তুপ রেখে গেছে, সেখান থেকে বের হওয়া কঠিন। যেদিকে হাত দেই, সেদিকেই ভাঙাচোরা। এই ভাঙাচোরা পরিষ্কার করেই যাচ্ছি। কাজ শুরু করতে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।’
শিক্ষার্থীরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে সংস্কারকাজে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তারা জানান, দেশের মানুষ সরকারের পাশে আছে। এটি গণমানুষের সরকার। জনগণ চায় অন্তর্বর্তী সরকার যেন প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজটি সম্পন্ন করে।
প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘দেশের মানুষ ছাত্রদের ওপর ভরসা করে। এই বিশ্বাস ধরে রেখো। হাতছাড়া কোরো না। তোমরা কখনোই আশাহত হবে না। তোমরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছ। দেশ বদলে ফেলেছ। তোমরাই পারবে। মানুষের আশা তোমাদের পূরণ করতে হবে। অন্তত সে পথে তোমাদের অগ্রসর হতে হবে। এক বিজয় করেছ, আরেক বিজয় আসবে। তোমরা বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেবে যেন আমরাও সতর্ক হই, সজাগ হই।’
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মাহফুজ আলম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা নহিদ ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি দলে ছিলেন আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সদস্য সচিব আরিফ সোহেল, মুখপাত্র উমামা ফাতেমা, সমন্বয়ক সারজিস আলম, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনসহ অন্যরা।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন