Sunday 08 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সিরিয়ায় আসাদের পতন: মধ্যপ্রাচ্যে বদলে যাবে ক্ষমতার ভারসাম্য

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১১:১৫ | আপডেট: ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১১:৫১

সিরিয়ার সরকার বিরোধী যোদ্ধাদের তাদের দখলকৃত মধ্য-পশ্চিম শহর হামাতে উদযাপনের চিত্র। ছবি: সংগৃহীত


বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০০০ সালে। এরপর পেরিয়ে গেছে ২৪ বছর। মাঝে দেশটির কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতি কর্মীদের হাত ধরে এসেছে ‘দামেস্ক বসন্ত’। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া পর্যন্ত হস্তক্ষেপ শুরু করে সিরিয়ায়। কিন্তু বাশার আল-আসাদ টিকে ছিলেন ক্ষমতায়। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের অভিযানের মুখে দামেস্ক ছেড়ে পালাতে হলো আসাদকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন এক পালাবদল এনে দিতে পারে। সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্যেও বদল আসবে নিশ্চিতভাবেই। ইরান, ফিলিস্তিন, ইসরায়েল, লেবানন, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রাজনীতি নতুন রূপ নেবে এর ফলে। বিশেষ করে এটি ইরানের জন্য হবে বড় ধরনের আঘাত।

বিজ্ঞাপন

গত কয়েক দিন ধরেই সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সব শহর একের পর এক দখলে নিচ্ছিল বিদ্রোহীরা। আসাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সেনাবাহিনীর সঙ্গে তীব্র যুদ্ধ হলেও বিদ্রোহীদের দমানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত রোববার (৮ ডিসেম্বর) স্থানীয় সময় ভোরে বিদ্রোহীরা রাজধানী দামেস্ক নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ঘোষণা দেয়।

সিরিয়ার দামেস্কে বিদ্রোহীদের উল্লাস। ছবি: অনলাইন

একই সময়ে বিদ্রোহীরা দাবি করেন, আসাদ দামেস্ক ছেড়ে পালিয়েছেন। দেশটির সেনাবাহিনীর দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাও রয়টার্সকে জানিয়েছে আসাদের দামেস্ক ছেড়ে যাওয়ার কথা।

সামরিক কর্মকর্তারা যে সময়ের কথা বলেছেন, ওই সময়ে দামেস্ক ছেড়ে একটি ফ্লাইট উড্ডয়নের তথ্যও মিলেছে, যদিও সেই ফ্লাইটে যাত্রী হিসেবে কে ছিলেন, সেটি স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে পারেনি রয়টার্স। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, আসাদই ছিলেন ওই ফ্লাইটের যাত্রী, দীর্ঘ ২৪ বছর পর যিনি শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের অভিযানের মুখে সিরিয়া ছাড়তে বাধ্য হলেন।

বিজ্ঞাপন

প্রায় দেড় দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধরত দেশগুলোতে কাজ করছেন আল জাজিরার প্রতিবেদক জেইনা খোদর। বর্তমানেও লেবাননের বৈরুতে রয়েছেন তিনি।

জেইনা বলেন, আসাদ সরকারের পতন ইরানের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। কারণ গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নানা ধরনের রূপান্তর এসেছে। বিশেষ করে এই অঞ্চলে ইরানের ক্ষমতা ও প্রভাব ব্যাপকভাবে বেড়েছে এবং সেটি গোটা অঞ্চলেই।

জেইনা বলেন, ইরাক থেকে শুরু করে সিরিয়া, এবং এমনকি লেবাননেও ইরানের প্রভাব ছিল বিস্তৃত। এসব দেশের ক্ষমতায় যারা ছিল, সবার সঙ্গেই ইরান সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্য ছিল ইরানের পক্ষে।

কেবল সিরিয়া নয়, লেবাননেও গত কয়েক বছরে ইরান তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে ইরানই সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে— এমন তথ্য সর্বজনস্বীকৃত। ফিলিস্তিন ও লেবানন ছাড়িয়ে ইসরায়েলের ইরানে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পেছনেও রয়েছে মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ।

আসাদের পতন এবং সাম্প্রতিক সময়ের যুদ্ধাবস্থা ইরানের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন জেইনা। তিনি বলেন, ইরানের মিত্র হিজবুল্লাহ গত কিছুদিনে মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান যুদ্ধে গত কয়েক সপ্তাহে টানা আক্রমণের মুখে তাদের সামরিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ইসরায়েল সরাসরি হিজবুল্লাহর সব সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ করেছে, তাদের যোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করেছে। ফলে হিজবুল্লাহকে বহু ঘাঁটি হারাতে হয়েছে, বহু যোদ্ধা হারাতে হয়েছে।

দীর্ঘ আলোচনার পর লেবাবনের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে। তাতে অবশ্য খুব একটা কাজ হচ্ছে না। কারণ গত সপ্তাহেই লেবানন সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে অন্তত ৫৬ বার যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের অভিযোগ এনেছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে।

বৈরুতে অবস্থানরত জেইনা বলেন, হিজবুল্লাহর পক্ষে এখন ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে গেছে। লেবাননে যুদ্ধবিরতি চললেও এর মূল বার্তাই হলো— হিজবুল্লাহকে অন্ত্র ছাড়তে হবে। আর হিজবুল্লাহ অস্ত্র ছেড়ে দুর্বল হয়ে পড়লে তার প্রভাব ইরানের ওপরও পড়বে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী চাইছে, হিজবুল্লাহ যেন আর সশস্ত্র না হয়ে উঠতে পারে। ইরানকেও যথাসম্ভব দমিয়ে রাখতে চায় ইসরায়েল। এ কারণেই গত কিছুদিনে কেবল লেবানন নয়, সিরিয়াতেও ইসরায়েলি বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণ দেখা গেছে। কারণ ইসরায়েলের ধারণা, সিরিয়ার ওইসব এলাকায় ইরানের সামরিক অবস্থান রয়েছে।

এদিকে সিরিয়ার চলমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া-তুরস্কের নামও জড়িয়ে রয়েছে। সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামসকে (এইচটিএস) সরাসরি সমর্থন দিয়েছে তুরস্ক। এ বছরের শুরুতে সিরিয়ার সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল তুরস্ক। কিন্তু সিরিয়া থেকে তুরস্কের বাহিনী সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত সিরিয়া কোনো আলোচনায় বসবে না বলে জানিয়েছি।

দ্য গার্ডিয়ানের কূটনৈতিক সম্পাদক প্যাট্রিক উইনটুর বলেন, এ ঘটনার জের ধরেই সম্ভবত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন হায়াত তাহরির আল-শামসকে। সেই সবুজ সংকেট পেয়েই গত মাস থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি আক্রমণ অব্যাহত রাখতে থাকে।

এর আগে ২০১৭ সাল থেকে রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সিরিয়ায় শান্তি ফেরানোর জন্য। তিন দেশের মধ্যে ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত ২১টি বৈঠক হলেও অচলাবস্থা কাটেনি। সবশেষ সম্প্রতি কাতারের দোহায় তিন দেশের মধ্যে বৈঠকের পর দেশ তিনটির অবস্থান দাঁড়ায় এমন— সিরিয়ায় বিদ্রোহী, ইসলামপন্থি ও তুরস্কপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠীদের উপস্থিতিতে তুরস্কের কোনো আপত্তি নেই। অন্যদিকে তাহরির আল-শামসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করে আসছে ইরান ও রাশিয়া।

প্যাট্রিক উইনটুর বলেন, দোহার বৈঠকে ইরান বারবার চেষ্টা করেছে এটা বোঝানোর জন্য যে সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের এভাবে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে আসাদ সরকারে পতন ঘটালে তা ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি করবে, যার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসীরা রাজত্ব কায়েম করবে। এ ক্ষেত্রে সুযোগ নেবে ইসরায়েল, যারা মূলত এই সিরিয়ার সংঘাতকে অস্ত্র করে সিরিয়া থেকে লেবানন পর্যন্ত ইরানের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের রুটকে বন্ধ করে দিচ্ছে।

বিদ্রোহীদের হাত থেকে আসাদ সরকারকে বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সর্বোচ্চ দর কষাকষির চেষ্টাই করেছে ইরান। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আববাস আরাগচি ইরাকের প্রতিও আহ্বান জানান, যেন তারা সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে সামরিক সহায়তা দেয়। আরাগচি বলেন, ‘ভালো বা মন্দ সন্ত্রাসী বলে কিছু নেই। সন্ত্রাসীরা সবাই সমান।’ কিন্তু ইরাক তার সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি।

গার্ডিয়ানের প্যাট্রিক উইনটুর বলেন, সব মিলিয়ে সিরিয়া ইস্যুতে ইরান অনেকটাই একা হয়ে পড়েছে। আঞ্চলিক রাজনীতি এখন ইরানের জন্য অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়বে।

আল জাজিরার জেইনাও বলেন, আসাদের শাসনের অবসানের পর সিরিয়ায় কী ঘটবে, সেটি এখনই বলা মুশকিল। তবে তার পতন বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখল মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যে একটি বড় ধরনের পালাবদলের সূচনা। এটি ইরানের জন্যও নিঃসন্দেহে একটি বড় ধাক্কা।

সারাবাংলা/টিআর

আসাদ সিরিয়া

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর