আসাদের ‘আয়নাঘরে’ বন্দি ছিলেন তারা
৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১১:১৮
তিন বছর ধরে সিরিয়ার সাইদনায়া কারাগারে বন্দি ছিলেন তরুণ ওমর আল-শোগরে। সেখানকার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কী ভয়ংকর কষ্ট আর একাকীত্ব সেখানে! একই সঙ্গে তীব্র অসহায়ত্ব। কারণ আপনি জানেন, সবাই জানে যে আপনি সেখানে বন্দি। কিন্তু তারা আপনাকে সেখানে নির্যাতিতত হতে দিচ্ছে এবং এ নিয়ে কিছুই বলছে না।’
ওমর আরও বলেন, ‘আমার এক ভাই ছিলেন, তাকে আমি খুব পছন্দ করতাম। তারা আমার সেই ভাইকে বাধ্য করেছে যেন সে আমাকে নির্যাতন করে। আবার আমাকে বাধ্য করেছে তাকে নির্যাতন করার জন্য। আমরা সেটিই করতে বাধ্য হয়েছি। কারণ আমরা জানতাম, আমরা যদি তা না করি, তাহলে দুজনকেই প্রাণ হারাতে হবে।’
সিরিয়ার কুখ্যাত সাইদনায়া কারাগারে নিষ্ঠুর নির্যাতনের এমন অভিজ্ঞতা বিবিসির কাছে রোববার (৮ ডিসেম্বর) তুলে ধরেন ওমর, যখন দেশটিতে ২৪ বছর ধরে ক্ষমতা ধরে রাখা বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন হয়েছে। বাশারের পতনের পরপরই অবসান ঘটেছে ভয়ংকর সাইদনায়া কারাগারের, ভূগর্ভস্থ গোপন যে কুঠুরিতে বন্দি রাখা হয়েছিল হাজার হাজার মানুষকে। চালানো হতো নির্মম নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ।
বাংলাদেশে মানুষকে গুম করে যেভাবে ‘আয়নাঘরে’ আটকে রেখে চরম নির্যাতন চালানো হয়েছে, বছরের পর বছর তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি, সাইদনায়া কারাগারও ছিল সেই আয়নাঘরের মতো। সেখানে কেউ একবার ঢুকলে তার আর কোনো সন্ধান মিলত না। সেখানে আটক বহু মানুষের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি, তাদের পরিবাররা জানত না সেই ব্যক্তি আর বেঁচে আছে কি না।
২০১৭ সালে সাইদনায়া কারাগারে ভয়াবহ কিছু নির্যাতনের তথ্য প্রকাশ্য হলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একে ‘মানব কসাইখানা’ বলে উল্লেখ করেছিল। তারা বলেছিল, আসাদ সরকার সেখানে বন্দিদের হত্যার জন্য অনুমতি দিয়ে রেখেছে।
রোববার আসাদের পতনের পর সিরিয়াভিত্তিক বেসামরিক প্রতিরক্ষা গোষ্ঠী হোয়াইট হেলমেটস জানিয়েছে, তারা কুখ্যাত সাইদনায়া কারাগার থেকে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করছে। এক্স হ্যান্ডেলে এক পোস্টে সংগঠনটি লিখেছে, তারা এ কাজে পাঁচটি ‘বিশেষায়িত জরুরি টিম’ মোতায়েন করেছে। ওই কারাগারের কাঠামো সম্পর্কে অবগত একজন গাইড তাদের সহায়তা করছেন।
প্রেসিডন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার বিদ্রোহীরা যেসব কারাগার মুক্ত করে দেয় তার একটি সাইদনায়া। দামেস্কের প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা কয়েদিদের মুক্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এসব বন্দিদের অনেকেই বন্দিশালায় বায়ু চলাচলের অভাবে শ্বাসরোধে মারা যেতে বসেছিলেন।
দামেস্ক কান্ট্রিসাইড গভর্নরেট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশটির সাবেক সেনা ও কারা কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন বন্দিশালাগুলোর ইলেকট্রনিক দরজার গোপন কোড বিদ্রোহীদের কাছে সরবরাহ করে। কারণ তারা এখনো অনেক কারাগারের অনেক দরজাই খুলতে পারেনি, যেগুলোতে এখনো লক্ষাধিক মানুষ আটক হয়ে রয়েছেন, যাদের সিসিটিভি মনিটরেও দেখা যাচ্ছে।
দামেস্ক দখলে নেওয়ার পর সিরিয়ার বিদ্রোহীরা বিভিন্ন সরকারি কারাগার থেকে বন্দিদের মুক্ত করতে থাকে। বন্দিদের মুক্তির প্রচেষ্টার কিছু ভিডিও আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কারাগারের নিচের অংশগুলোতে পৌঁছাতে বেগ পেতে হচ্ছে। আরেক ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি একটি গুঁড়ি ব্যবহার করে নিচের একটি দেয়াল ভেঙে ফেলছেন, যার পেছনে কেবলই অন্ধকার।
অন্য এক ভিডিওতে দেখা গেছে বন্দিদের মুক্ত করার দৃশ্য। এ সময় ছোট শিশুকেও মায়ের সঙ্গে বন্দি অবস্থায় দেখা গেছে। শিশুটির মুক্তির সময়কার ভিডিও পোস্ট করেছে তুরস্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ডিটেইনিস অ্যান্ড দ্য মিসিং ইন সাইদনায়া প্রিজন (এডিএমএসপি)। ওই ভিডিওতে একজনকে চিৎকার করে কথা বলে বন্দি নারীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। তিনি বলছিলেন, ‘ভয় পেও না। তার (আসাদ) পতন হয়েছে।’
এএফপির যাচাই করা আরেক ভিডিওতে দেখা যায়, সিরিয়ানরা মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে তাদের আত্মীয় আছে কি না তা দেখতে ছুটে গেছে সাইদনায়া কারাগারের দিকে, যেখানে আসাদের শাসনামলে হাজার হাজার বিরোধীকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে।
২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে লাখ লাখ মানুষকে আসাদের নেতৃত্বাধীন সরকারি বাহিনী বিভিন্ন বন্দি শিবিরে নিয়ে আটকে রাখে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এসব বন্দিশিবিরে নির্যাতন ছিল অত্যন্ত ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা।
আসাদ সরকারের পতনে নেতৃত্ব দেওয়া হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) শনিবার জানিয়েছে, তারা হোমস শহরটি দখলে নেওয়ার পর কেবল হোমস সামরিক কারাগার থেকেই সাড়ে তিন হাজারের বেশি বন্দিকে মুক্ত করেছে। রোববার ভোরে রাজধানী দামেস্ক দখলে নেওয়ার পর এইচটিএস সাইদনায়া কারাগারের নির্যাতনের যুগেরও সমাপ্তি ঘোষণা করে, যেটি আসাদের শাসনামলের অন্ধকারতম নির্যাতনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তুরস্কভিত্তিক এডিএমএসপি ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে বলেছে, সাইদনায়া ‘গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কার্যত একটি মৃত্যুশিবিরে পরিণত হয়েছিল।’ তাদের অনুমান, ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি বন্দিকে হয় হত্যা করা হয়েছে, অথবা নির্যাতনের শিকার, চিকিৎসার অভাব বা ক্ষুধার কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়া কিছু বন্দিকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অন্তত ৫০০ বন্দিকে হত্যা করা হয়েছে।
২০১৭ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদ সাইদনায়াকে ‘কসাইখানা’ অভিহিত করার প্রতিবেদনকে ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘অসত্য’ বলে প্রত্যাখ্যান করে আসাদ সরকার। তাদের দাবি ছিল, সিরিয়ায় যাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, সব ধরনের ‘যথাযথ প্রক্রিয়া’ মেনেই সম্পন্ন করা হয়েছে।
রয়টার্সে প্রচারিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, বিদ্রোহীরা সাইদনায়া কারাগারের গেটের তালা ভেঙে বন্দিদের মুক্ত করছে। আরেকটি ফুটেজ ছিল দামেস্কের রাস্তায় ধারণ করা, যেখানে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের দৌড়াতে দেখা গেছে।
ভিডিওতে এক পথচারীকে জিজ্ঞাসা করতে শোনা যায়, ‘কী হয়েছে?’ জবাবে মুক্তি পাওয়া বন্দিদের উচ্ছ্বাস নিয়ে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা সরকারের পতন ঘটিয়েছি।’
দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে সিরিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন বাশার আল আসাদ। বিশ্লেষকরা বলছেন, আর সব একনায়ক ও কর্তৃত্ববাদী সরকারের মতো আসাদ সরকারেরও অন্যতম হাতিয়ার ছিল বিরোধী মত দমন। সেটি করতে গিয়ে বিরোধী মতের হাজার হাজার মানুষকে বছরের পর বছর বন্দি রাখা হয়েছে, নির্যতিন-নিপীড়ন চালানো হয়েছে, তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। সাইদনায়া ছিল তেমনই এক বন্দিশালা, যেখানে নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন আর নির্বিচারে হত্যাই ছিল বন্দিদের নিয়তি। সেখানে যারা গিয়েছে, তাদের অনেকেই আর কখনো ফিরে আসেনি কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরাও বছরের পর বছর তাদের কোনো খোঁজ পাননি।
সিরিয়ার মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য বলছে, ২০১১ সাল থেকে এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে এমন গুম, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তবে এ ধরনের নির্যাতনের ইতিহাস আরও পুরনো। সে কারণেই প্রকাশ্য ও গোপন কারাগারগুলোকে আসাদ সরকারের কালো অধ্যায়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়। রোববার আসাদ সরকারের পতনের পর কারাগার থেকে মানুষকের মুক্তিও তাই সেই অন্ধকার অধ্যায়ের অবসানের প্রতীকী চিত্র হয়ে থাকবে।
সারাবাংলা/টিআর