‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ পদ্ধতিতে ফিরছে ভারত
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:১১ | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:০০
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতে ‘এক দেশ, এক ভোট’ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করার পথে একধাপ অগ্রসর হয়েছে। ভারত নিজেদের এমন এক নির্বাচনি মডেল করতে চাইছে, যেখানে নাগরিকরা একসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য (ফেডারেল) সরকার নির্বাচিত করার সুযোগ পাবে। ১৯৬৭ সালে বাতিল হওয়া পদ্ধতিতে পুনরায় ফিরতে চলছে দেশটি।
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে জানান, বিভিন্ন মঞ্চে আলোচনার পরেই ‘এক দেশ, এক ভোট’-সংক্রান্ত কোবিন্দ কমিটির সুপারিশ অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এনডিটিভি প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীনতা অর্জন করে তখন একসঙ্গে সংসদীয় ও রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের মডেল পরিকল্পনা করেন। ১৯৫২ সালে প্রথম নির্বাচন থেকে ভারতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছিল। তবে ১৯৬৭ সালে উত্তর প্রদেশ ছাড়া সবখানে একসঙ্গে ভোট হয়েছিল। উত্তর প্রদেশে ভোট হয়েছিল চার দফায়।
এরপর জোট রাজনীতি তুঙ্গে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত দেশটিতে একযোগে ভোটের রীতির অবসান ঘটে। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসই ছিল একমাত্র দল- যারা ভারত শাসন করেছে, কিন্তু ততদিনে তারা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
ছয় দশক পর ভারত এখন ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ পদ্ধতি ফের চালু করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী নেতৃাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই প্রস্তাবে সায় দিয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিল অনুমোদন করেছে। বিলটি পাসের জন্য পার্লামেন্টের চলমান অধিবেশনে তোলা হতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পূর্বের ভোট ব্যবস্থা ফেরানোর আগে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্যানেল গঠন করা হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট রাম নাথ কোবিন্দ। অতীতে ভারতে কীভাবে এমন নির্বাচন পরিচালনা হয়েছিল এবং সেই সময়ে ফাঁকফোকরগুলো কী ছিল এই প্যানেল খতিয়ে দেখেছে। এছাড়া, বিশ্বজুড়ে কীভাবে এমন নির্বাচন পরিচালিত হয় তা নিয়ে বিস্তৃত গবেষণাও চালিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী গবেষণার সময় প্যানেলটি সাতটি দেশের উপর নজর দিয়েছিল, যারা সফলভাবে একযোগে নির্বাচন পরিচালনায় সফলতা দেখিয়েছে। এই সাত দেশ হচ্ছে- দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, বেলজিয়াম, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স ও জাপান। ওই প্যানেল তাদের অনুসন্ধান এবং নিজেদের প্রস্তাবিত মডেল চলতি বছরের শুরুতে প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে জমা দেয়।
প্যানেল তার প্রতিবেদনে বলেছে, এ ধরনের নির্বাচনি প্রক্রিয়ার দেশগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের কার্যকারিতা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। সর্বোত্তম আন্তর্জাতিক অনুশীলন শিখতে ও তা গ্রহণ করতে এবং নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে যুগপৎ নির্বাচন পরিচালনাকারী বিভিন্ন দেশের একাধিক মডেল নিয়ে বোঝাপড়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় ভোটাররা একইসঙ্গে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক আইনসভার জন্য ভোট দেন। তবে পৌরসভা নির্বাচন প্রাদেশিক নির্বাচন থেকে আলাদাভাবেই অনুষ্ঠিত হয়।
সুইডেন একটি আনুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থা রয়েছে। এর মানে হচ্ছে- একটি রাজনৈতিক দল অ্যাসেম্বিলিতে কতটি আসন বরাদ্দ পাবে তা নির্ভর করে ভোটের হিস্যার ওপর। তাদের এমন এক পদ্ধতি রয়েছে, যেখানে পার্লামেন্ট (রিকসড্যাগ), কাউন্টি কাউন্সিল এবং পৌর কাউন্সিলের নির্বাচন একই সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি চার বছর অন্তর সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় রোববার এই ভোট হয়, যেখানে মিউনিসিপ্যাল অ্যাসেম্বলির ভোট হয় প্রতি পাঁচ বছরে একবার, সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় রোববার।
ভারতের মতো ইন্দোনেশিয়াও ২০১৯ সালে ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ পদ্ধতি চালু করেছে। প্রেসিডেন্ট, ভাইস-প্রেসিডেন্ট, এমপি এবং আঞ্চলিক আইনসভার সদস্য এবং পৌর ভোট একই দিনে হয়।
উচ্চ পর্যায়ের প্যানেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় পার্লামেন্টের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর চার শতাংশ ভোটের প্রয়োজন। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে হলে সারাদেশে পড়া ভোটের অর্ধেকের বেশি যেমন পেতে হয়, তেমনই অর্ধেকরও বেশি প্রদেশের ভোটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ পাওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে।
প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইন্দোনেশিয়া সফলভাবে যুগপৎ নির্বাচন আয়োজন করেছে। প্রেসিডেন্ট, ভাইস-প্রেসিডেন্ট, এমপি, আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য ও পৌর নির্বাচনে প্রায় ২০ কোটি মানুষ অংশ নেওয়ার পর এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম যুগপৎ নির্বাচন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল।
এনডিটিভি লিখেছে, ১৪০ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ ভারত এখন বৃহত্তম যুগপৎ নির্বাচন আয়োজন করে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। ২০২৯ সালে সেই আয়োজন হবে কি না- তা এখনও নিশ্চিত নয়। তার আগে প্রস্তাবটিকে পার্লামেন্টে পাস হতে হবে।
কেন্দ্রের দাবি ভারতে বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয় তা কমানোই সরকারের উদ্দেশ্য। ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতি কার্যকর হলে নির্বাচনের খরচ কমবে। সময়েরও সাশ্রয় হবে কারণ প্রশাসনিক কাজ বারবার বিঘ্নিত হয় ভোট কেন্দ্র করে।
অভিন্ন ভোটার তালিকা তৈরি হওয়ায় সুবিধা হবে বলে মনে করছে তারা। পাশাপাশি ভোটের আদর্শ আচরণবিধির জন্য সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ বারে বারে বাধা পাবে না।
তবে প্রস্তাবিত এই নির্বাচনী ব্যবস্থার বিপক্ষে সরব হয়েছে বিরোধীরা। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, ‘মনোযোগ সরানোর জন্য এটা বিজেপির একটা কৌশল।’
সারাবাংলা/এইচআই