ফিরে দেখা ২০২৪
‘এমনি এমনি’ ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ই-কমার্স-আইসিটি-ফ্রিল্যান্সিংয়ে বড় ধাক্কা
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:০৫
ঢাকা: বিদায় নিতে যাওয়া ২০২৪ সালে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত ছিল আলোচনার শীর্ষে। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলন ঘিরে প্রায় ১৩ দিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় জনজীবনে বিপর্যয় ঘটে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেট বন্ধে হোঁচট খায় দেশের আইসিটি খাত। ধ্বস নামে অনলাইন কেনাকাটা ও ই-কমার্স খাতে। ক্রেতা হারিয়ে হুমকির মুখে পড়েন ফিল্যান্সার ও সফটওয়্যার ব্যবসায়ীরা।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে আওয়ামী সরকার পতনের পর গ্রেফতার হন ইন্টারনেট বন্ধের ‘হোতা’ সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। আন্দোলন চলাকালে ইন্টারনেট বন্ধ করা নিয়ে তার ‘ইন্টারনেট এমনি এমনি বন্ধ হয়ে গেছে’সহ একাধিক বক্তব্য ভাইরাল হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই আইসিটি খাতে অবসান ঘটে পলক যুগেরও। কেউ কেউ ধরা পড়লেও পলকের সঙ্গী-সহযোগীদের বেশির ভাগই এখনো প্রায় লাপাত্তা। কেউ কেউ পরিচয় পালটে এখন আন্দোলনের সহযোগী হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।
এদিকে হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তবর্তী সরকারের মেয়াদে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে, আইসিটির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেও এসেছে পরিবর্তন। দেশের প্রথম মোবাইল অপারেটর সিটিসেল তাদের লাইসেন্স ফিরে পেতে আবেদন করেছে। সব মিলিয়ে ২০২৪ সালকে ‘আইসিটিতে পলকের বিপর্যয়’ হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ।
-
ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ
জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের সময় দেশে ইন্টারনেট বন্ধ ছিল প্রায় ১৩ দিন। এর মধ্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ ছিল আট দিন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ ছিল প্রায় ১৫ দিন। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, কেবল ইন্টারনেট বন্ধের কারণেই প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছিল। ব্যাংক-বিমা-চিকিৎসা সবকিছু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্থবিরতা নেমে আসে পোশাক খাতেও। অস্থিরতা দেখা দেয় ই-কমার্স খাতে। কাজ হারান ফ্রিল্যান্সাররা।
-
পলকের নির্দেশে ইন্টারনেট বন্ধ
সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নির্দেশেই ইন্টারনেট বন্ধ হয় বলে সরকারের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ ও ১৬ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ থেকে ২৩ জুলাই ও ৫ আগস্ট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ ও চালুর বিষয়টি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়াই তখনকার প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের মৌখিক নির্দেশে বাস্তবায়ন করা হয়। আর সে নির্দেশ তামিল করেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ।
এ ছাড়া ১৭ থেকে ২৮ জুলাই ও ৫ আগস্ট মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ও চালু করার বিষয়টি এনটিএমসির নির্দেশনায় করা হয়। ওই সময় ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে ডাটা সেন্টারে আগুন লাগাকে কারণ হিসেবে দেখান প্রতিমন্ত্রী পলক। পরে জানা যায়, ওই ডাটা সেন্টারে আগুন লাগার সঙ্গে ইন্টারনেট বন্ধের কোনো সম্পর্কই ছিল না।
ইন্টারনেট বন্ধ করা নিয়ে পলকের বেশ কয়েকটি বক্তব্য ‘ভাইরাল’ হয়। পলক শুরুতে বলেন, ‘পরিস্থিতি বুঝে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে।’ পরে সে বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা ডাটা সেন্টারে আগুন দেওয়ায় ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’
সবার মোবাইলে মেসেজ করে পর্যন্ত বলা হয়, ‘সন্ত্রাসীদের আগুনের কারণে ডেটা সেন্টার পুড়ে যাওয়া এবং আইএসপির তার পুড়ে যাওয়ার কারণে সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত, মেরামত করতে সময় লাগবে।’ পরে পলক আবার বলেন, ‘ইন্টারনেট বন্ধ করিনি, এমনি এমনি বন্ধ হয়ে গেছে।’
-
গ্রেফতার পলক
৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর ৬ আগস্ট দুপুরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটক হন জুনাইদ আহমেদ পলক। পরে ১৪ আগস্ট তাকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। জুলাই-আগস্টে গণহত্যার মামলার এই আসামি এখন কারাগারে রয়েছেন।
আইসিটি বিভাগের এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পলকের নির্দেশেই ইন্টারনেট বন্ধ হয়েছিল। তবে শেখ হাসিনার নির্দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল বলে অন্তবর্তী সরকার গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক।
-
ই-ক্যাবে ক্ষতি হাজার কোটি
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনে অস্থির ছিল দেশের ই-কমার্স খাত। শুরু ও শেষ প্রায় ভালো হলেও বছরের মধ্যভাগ ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের জন্য খুবই খারাপ গেছে। সরকার পতনের আগে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে ই-কমার্স খাতে। এর পরের সময়কার তথ্য অবশ্য আসেনি। অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতায় বসার প্রায় ছয় মাস হতে চললেও পুরো স্বস্তি ফেরেনি ই-কমার্স খাতে। বন্ধ রয়েছে অনেকের ব্যবসা।
ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে ই-কমার্স খাতে ১৭০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির তথ্য দেয় ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)। সরকার পতনের পরে অবশ্য অন্য সংগঠনের মতো এই সংগঠন থেকেও ক্ষয়ক্ষতির কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। অবশ্য সংগঠনটিই প্রায় নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে।
পদত্যাগের পর গ্রেফতার হন ই-ক্যাবের তিন মেয়াদের সভাপতি শমী কায়সার। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ২৭ জুলাই নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও আওয়ামী সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংগঠনটিতে প্রশাসক বসায় অন্তবর্তী সরকার।
-
ধাক্কা লাগে ফ্রিল্যান্সিংয়ে
ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে দেশের ফিল্যান্সিং খাতে বড় ধাক্কা লাগে। ক্রেতাদের আস্থা হারানোয় এর প্রভাবও দীর্ঘমেয়াদি হয়। এখনো অনেক ফিল্যান্সার কাজ পাননি। আগের ক্রেতা হারিয়েছেন অনেকেই। অনেক ক্রেতা বা প্রতিষ্ঠান এখন বাংলাদেশে কাজ দিতে আগ্রহ কম দেখান, এমন তথ্য ফিল্যান্সারদের। আর ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময়ে জরুরি কাজ করতে অনেক ফ্রিল্যান্সার পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল ও ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। কয়েকটি আইটি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের নেপাল পাঠিয়েছিল।
-
বন্ধ ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটক
কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে বন্ধ করে দেওয়া হয় ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটক। এতে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন অনেকেই। দেশে এসব সামাজিক প্ল্যাটফর্ম বন্ধ থাকায় ব্যবহার বাড়ে ভিপিএনের। তথ্যপ্রযুক্তি খাতসংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, এতে সাইবার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
-
বেসিসে অস্থিরতা
২০২৪ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসে (বেসিস) নতুন নেতৃত্ব আসে। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই অস্থির হয়ে ওঠে বেসিস। সংগঠনটির সভাপতি রাসেল টি আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে। শিক্ষার্থীরা কারওয়ান বাজারে সংগঠনটির কার্যালয়ে অবস্থান নেন।
শিক্ষার্থীদের ওই দাবি না মানলেও পরে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন রাসেল টি আহমেদ। সরকার ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের প্রিয় পাত্র ও আস্থাভাজন ছিলেন— এমন অভিযোগ রয়েছে রাসেল টি আহমেদের বিরুদ্ধে। তার পদত্যাগের মধ্য দিয়েও সংগঠনটির পরিবর্তিত ‘রাজনৈতিক’ অস্থিরতা কাটেনি। তার উত্তরসূরী হিসেবে বেসিস সভাপতি হন এম রাশিদুল হাসান। নতুন করে কমিটিও পুর্নবিন্যস্ত হয়। তবে বেসিসের একটি পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংগঠনটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। আর বেসিস চালাতে একটি সহায়ক কমিটি করেন প্রশাসক, যেখানে আইসিটি খাতের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যবসায়ীদের অধিক্য ছিল একেবারেই কম। এ নিয়েও সমালোচনার ঝড় উঠে। আর বেসিসসহ আইসিটি খাতের অস্থিরতার তথ্য প্রায়ই প্রকাশ্যে আসে বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও। সেই রাজনৈতিক অস্থিরতা এখনো কাটেনি।
-
বেসিসের সাবেক সভাপতি আলমাস কবীর গ্রেফতার, পরদিন জামিন
গত ১৪ অক্টোবর বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর গ্রেফতার হন। পরদিন ১৫ অক্টোবরই তিনি জামিন পান। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় মোহাম্মদপুরে দিনমজুর আক্তার হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় আলমাস কবীরকে।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আইসিটি খাতের ব্যবসায়ীরা। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখায় বেসিস। হয়রানিমূলক মামলায় আলমাস কবীরের নামে মামলা ও তাকে গ্রেফতারে প্রতিবাদে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। পরে অবশ্য সে সভা স্থগিত করা হয়। বেসিসের একটি পক্ষের ইন্ধনে ওই মামলায় ‘ফাঁসানো হয়েছে’ বলে দাবি আলমাস কবীরের।
-
সিটিসেলের ফিরে আসার ঘোষণা
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ফিরে আসার চেষ্টায় রয়েছে দেশের প্রথম মোবাইল অপারেট সিটিসেল। লাইসেন্স ফিরে পেতে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) চিঠি দিয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে সিটিসেলের কার্যক্রম।
চিঠিতে কোম্পানিটি জানায়, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষের নয়— এমন একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সিটিসেল যুক্ত ছিল, এমন ‘অযৌক্তিক ধারণা’ থেকে সিটিসেলের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। গত আট বছরে সিটিসেলের মূল কোম্পানি প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (পিবিটিএল) বিটিআরসির পক্ষপাতদুষ্ট, অপ্রীতিকর ও অসৎ উদ্দেশ্যে নেওয়া সিদ্ধান্ত ও মূল্যায়নের শিকার হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
বিটিআরসির অনুমোদন পেলে নতুন বছরেই সিটিসেলের কার্যক্রম শুরু হতে পারে— এমন গুঞ্জন রয়েছে। কার্যক্রমে ফিরলে গ্রাহকরা আগের মতোই ২৫ পয়সা কলরেট পাবেন, এমন গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়ে।
সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর
আইসিটি খাত আইসিটি প্রতিমন্ত্রী আউটসোর্সিং আলমাস কবীর ই-ক্যাব ইন্টারনেট বন্ধ জুনায়েদ আহমেদ পলক তথ্যপ্রযুক্তি খাত ফ্রিল্যান্সিং বেসিস রাসেল টি আহমেদ সিটিসেল