দ্রুত নির্বাচন ইস্যুতে ৩ দলের অবস্থান দুই মেরুতে
৫ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:০৮
ঢাকা: ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু মাঠের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে মূলত তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপি, ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বাধীন জামায়াত আর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীমের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে ঘিরে। সরকার পতন আন্দোলনে এই তিনটি দল একসুরে কথা বললেও দ্রুত নির্বাচন ইস্যুতে তাদের অবস্থান এখন দুই ভিন্ন মেরুতে।
বিএনপি চায় দ্রুত নির্বাচন। অন্যদিকে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের চাওয়া— নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন ও পুলিশের ন্যূনতম সংস্কার শেষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সন্তোষজনক উন্নতি হলে তারপরই নিবন্ধিত সব দলের অংশগ্রহণে হোক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এ নিয়ে ‘মেঠো বক্তব্যে’র পাশাপাশি নিজ নিজ দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামেও বিস্তর আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে দলগুলো।
দলীয় সূত্রমতে, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করে আসা বিএনপির নীতিনির্ধারকরা এ ব্যাপারে আর বেশি দিন ধৈর্য না ধরার কথা ভাবছেন। তারা আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ চাওয়ার পক্ষে। সেটি না হলে নির্বাচনের দাবিতে মার্চ-এপ্রিলের দিকে কর্মসূচি শুরুর চিন্তা রয়েছে তাদের। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভাতেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্য, রাষ্ট্রসংস্কার নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতাসহ সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে নির্বাচন নিয়ে অনাগ্রহ স্পষ্ট হচ্ছে। সেই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দায়িত্বশীল নেতাদের নানা ধরনের বক্তব্যেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। এ কারণে বিএনপি চলতি বছরের প্রথামার্ধে নির্বাচনের রোডম্যাপ চাইবে। সেটা না পেলে রাজপথে আন্দোলন ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না।
সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন। দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ওই যেমন ৫ অগাস্ট ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, ঠিক সে রকম ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামতে হবে। রাস্তায় নামতে হবে অধিকার আদায়ের জন্য, ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য, ভাতের অধিকার আদায়ের জন্য, ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য, সামাজিক মর্যাদা পাওয়ার জন্য জন্য, নিজের অধিকার আদায়ের জন্য।’
এর আগে ঢাকার এক সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে কত দিন লাগবে, তা অন্তর্বর্তী সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে। কোনো ছলচাতুরি করা যাবে না। জনগণ এই সরকারকে দীর্ঘদিন মানবে না। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে সরকার কোনো কথা বলছে না। আমরা নির্বাচনের কথা বললেই তারা বলে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আমরা উদগ্রীব হয়ে পড়েছি। এখন আমরা যদি বলি, আপনারা নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতায় থাকার জন্য পাগল হয়ে গেছেন!’
জানা গেছে, গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের যে সম্ভাব্য সময়ের কথা বলেছেন, তাতে আস্থা রাখতে পারছেন না বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। ওই ভাষণের পর অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের নির্দিষ্ট মাস বা বছরের কথা উল্লেখ না থাকায় হতাশা জানান বিএনপি নেতারা। তার ওপর প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের সঙ্গে তার প্রেস সেক্রেটারির বক্তব্যের গড়মিল থাকায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তার প্রেস সেক্রেটারি আবার আরেকটা বলেছেন। আমরা মনে করি, নির্বাচনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার হওয়া উচিত। আগামী জুন মাসের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া উচিত। কোনো অবস্থাতেই ডিসেম্বর মাস অতিক্রম করা উচিত নয়।’
‘নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হলে অন্তর্বর্তী সরকারেরও লাভ। তারা ঠিকমতো দেশ পরিচালনা করতে পারবে। সবাই নির্বাচনমুখী হয়ে গেলে কেউ তাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) ডিস্টার্ব করার সাহস দেখাবে না,’— বলেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
তবে নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিএনপির বিপরীত মেরুতে। নির্বাচনের আগে বরং তাদের অগ্রাধিকার সংস্কার। দল দুটির ধারণা, প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন দিলে সেই নির্বাচন জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটবে না। নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও পুলিশের আমূল সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে জনবল ও পেশী শক্তির মাধ্যমে নির্বাচনের ফল এককভাবে নিজেদের করে নেবে বিএনপি। এরই মধ্যে দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলদারি ও আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগকে রেফারেন্স হিসেবে সামনে আনছেন জামায়াত ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের নেতারা।
সম্প্রতি এক বক্তব্যে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, ‘দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করার পরই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে নুতুন কোনো ফ্যাসিস্ট যেন তৈরি না হয়, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘তাড়াহুড়া করা হলে ১৪, ১৮ ও ২৪ সালে যে রকম নির্বাচন হয়েছে, ওই রকমই হবে। আপনি ভোট দিতে যাবেন; আর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, পুলিশ লীগ আপনাকে আটকে বলবে— আপনার ভোট হয়ে গেছে, বাড়ি চলে যান। এ জন্য আমি মনে করি, এখানে সময়টা মুখ্য নয়, আগে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’
অবশ্য জামায়াত ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের এই অবস্থান সম্পর্কে রাজনীতি বিশ্লেষকদের মূল্যয়ন, নির্বাচনে এই দল দুটির এককভাবে জয়ের ক্ষীণ সম্ভাবনাও না থাকায় ভোটের জন্য তাদের তাড়াহুড়া কম। তার ওপর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দল দুটি বেশ গুরুত্বও পাচ্ছে। নির্বাচন হয়ে গেলে রাজনৈতিক সরকারের কাছে সেই গুরুত্ব তারা নাও পেতে পারে।
এদিকে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ না থাকায় আগামী নির্বাচনে বিএনপির বিজয় একরকম নিশ্চিত। সারা দেশে সাংগঠনিক কাঠামো মজবুত থাকায় আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে বিএনপির একচেটিয়া জয় সম্ভব। এ কারণেই দলটি দ্রুত নির্বাচনের চাচ্ছে। নির্বাচন দেড়িতে হলে তাদের ক্ষমতারোহণও বিলম্বিত হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘জনপ্রশাসন, পুলিশ ও নির্বাচনব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া এবং আইনশৃঙ্খলার প্রভূত উন্নতি ছাড়া নির্বাচন দিলে সেই নির্বাচন ২০১৮ সালের নির্বাচনের চেয়ে খারাপ হবে। একটা যেনতেন নির্বাচনের জন্য ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এতগুলো মানুষ প্রাণ দেয়নি।’
‘আর বিএনপি বলছে যে তারা পার্লামেন্টে গিয়ে সংস্কার করবে। আগামীতে যে তারাই পার্লামেন্টে যাবে, সরকার গঠন করবে, তারা এটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে? নির্বাচনের ফল ভিন্নও তো হতে পারে! সুতরাং আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার, পরে নির্বাচন,’— এটাই আমাদের দলীয় অবস্থান।
দ্রুত নির্বাচন ইস্যুতে ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতে ইসলামীর এই অবস্থান সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘তাদের অবস্থান বাস্তবসম্মত নয়। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। কোনো একটি সরকারের পক্ষে সব সংস্কার করা সম্ভব না। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার ততটুকু করুক, যতটুকু করলেন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়। কিস্তু সংস্কারের কথা বলে নির্বাচনে দেরি করলে সমস্যা বাড়তেই থাকবে।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর
অন্তর্বর্তী সরকার ইসলামী আন্দোলন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জাতীয় নির্বাচন জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন বিএনপি