ভারত ফেরত জেলেদের প্রতিক্রিয়া
ভারতীয়দের ছাড়াতেই বাংলাদেশিদের ধরা হয়েছিল
৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:১০ | আপডেট: ৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:৫৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: প্রায়ই ২৪ দিন পর ভারতে আটক থাকা ৯০ জেলে-নাবিক মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেছেন। জেলে-নাবিকদের অভিযোগ, তাদের বিনা অপরাধেই ভারতীয় কোস্টগার্ডের সদস্যরা আটক করে নিয়ে যান। বাংলাদেশে আটক থাকা ৯৫ ভারতীয় জেলেকে ছাড়াতেই তাদের জোর করে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) সকালে নগরীর পতেঙ্গার ১৫ নম্বর ঘাট এলাকায় কোস্টগার্ডের দফতরে তারা এ অভিযোগ করেন। এদিন সকালে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পরিবারের সদস্য এবং ফিশিং ভেসেলের মালিকদের কাছে জেলে-নাবিকদের হস্তান্তর করেন।
এদিন সকালে পতেঙ্গার কর্ণফুলী চ্যানেলে এসে পৌঁছান আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় মাছ ধরতে গিয়ে ভারতীয় কোস্ট গার্ডের হাতে আটক এবং ঝড়ে ট্রলার ডুবে উদ্ধার ৯০ বাংলাদেশি নাবিক ও জেলে। দীর্ঘ ২৪ দিন পর উৎকণ্ঠায় থাকা স্বজন ও জেলে-নাবিকরা আপন মানুষদের কাছে পেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। কারও কারও চোখ বেয়ে পড়তে থাকে অশ্রু। সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন পরিবেশের।
এ সময় বাংলাদেশের ‘এফভি লায়লা-২’ এবং ‘এফভি মেঘনা-৫’ নামের দুটি ফিশিং ভেসেলও মালিকদের বুঝিয়ে দেয় কোস্টগার্ড। এর পর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে দুই ভেসেল করেই জেলে-নাবিকরা ফিরিঙ্গিবাজারের উদ্দেশে রওনা দেন। সেখানেই সবকিছু বুঝিয়ে তার নিজ নিজ ঘরে ফিরবেন।
এর আগে রোববার (৫ জানুয়ারি) বিকেল ৫টার দিকে বঙ্গোপসাগরে খুলনায় হিরণ পয়েন্ট এলাকায় আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমানায় ৯০ নাবিককে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের কাছে হস্তান্তর করেন ভারতীয় কোস্টগার্ড। তার আগে বাংলাদেশে আটক থাকা ৯৫ ভারতীয় জেলে ও ছয়টি ফিশিং বোট ভারতের কোস্টগার্ড কাছে হস্তান্তর করেছিলেন বাংলাদেশ কোস্টগার্ড।
গত বছরের ৯ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে বঙ্গোপসাগরে খুলনায় হিরণ পয়েন্ট এলাকা থেকে দুটি ফিশিং ভ্যাসেলসহ ৭৮ জেলে-নাবিককে ভারতীয় কোস্টগার্ড সদস্যরা আটক করে নিয়ে যান। এছাড়া গত ১২ সেপ্টেম্বর বঙ্গোপসাগরে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমার কাছে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এফবি কৌশিক নামে একটি মাছ ধরা ট্রলার ডুবে যায়। পরে ভারতীয় কোস্টগার্ড সেখান থেকে ১২ জেলেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।
এদিকে জেলে-নাবিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়ার পর কোস্টগার্ডের পূর্বজোনের জোনাল কমান্ডার জহিরুল হক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের জানান, ভারতের কোস্টগার্ডের অভিযোগ, বাংলাদেশি ফিশিং ভেসেল দুটি তাদের সীমানায় মাছ ধরছিল। পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ফেরানোর উদ্যোগ নেয়। দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে বন্দি বিনিময়ের সিদ্ধান্ত হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় কোস্ট গার্ডকে। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রোববার আন্তর্জাতিক জলসীমানায় ভারতের ৯৫ জেলেসহ ছয়টি ফিশিং বোট হস্তান্তর করা হয়। একইভাবে ভারতে থাকা ৯০ জেলে ও নাবিককে দুটি ফিশিং বোটসহ কোস্টগার্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এদিকে ভারতের বন্দিদশা থেকে ফিরে আসা নাবিক-জেলেদের অভিযোগ, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যেই তারা মাছ ধরছিলেন। ভারতীয় কোস্টগার্ডরা বাংলাদেশের সীমানায় এসে প্রথমে তাদের ফিশিং ভ্যাসেল তল্লাশি করেন। এর পর কিছু না পেয়ে তারা চলে যান। এর একঘণ্টা পর বার্তার মধ্যে দিয়ে ভারতীয় কোস্টগার্ডের সদস্যরা জানান, তাদের আইফোন-১৫ সিরিজের একটি মোবাইল তল্লাশির সময় জাহাজে পড়ে গেছে। সেটা নেওয়ার জন্য দুই ফিশিং ভ্যাসেলকে ভারতের সীমানায় যেতে বলেন তারা। এরপর তারা ওই দুটি ভ্যাসেলসহ ৭৮ জেলে-নাবিককে ভারতের উড়িশ্যার প্যারাদ্বীপ বন্দরে নিয়ে আটক করে রাখেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় আটক হওয়া ৯৫ ভারতীয় জেলেদের ছাড়াতেই তাদের আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভারত ফেরত জেলে-নাবিকরা। এফভি মেঘনা-৫ জাহাজের ক্যাপ্টেন রাহুল বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওরা আমাদের দু’টি জাহাজ সার্চ করার জন্য ওঠে। প্রথমে তারা লাইলা-২ তে ওঠে। সেটাতে প্রায়ই দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সার্চ করে। ওরা মনে করেছিল অবৈধ কোনো কাজ হচ্ছিল কি না। কিন্তু কোনো কিছু পাইনি তারা। পরে আমাদের জাহাজ সার্চ করে। তাদের কী উদ্দেশ্য ছিল সেটা তো আমরা জানি না। এরপর ওরা আমাদের ছেড়ে দেয়।’
‘আমরা বাংলাদেশের জলসীমায় আমাদের মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এরপর তারা রেডিও মারফত জানায়, আমাদের এখানে নাকি একটি আইফোন-১৫ প্রো মডেলের মোবাইল ফেলে গেছে। এটা আবার সার্চ করে দেখে আমাদের যেতে দেবে। এরপর আমরা গেলে তারা আমাদের আটক করে।’
তিনি বলেন, ‘আটক করার পর ওরা আমাদের জানিয়েছে, তাদের কিছু জেলে ও ফিশিং বোট বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। তাদের ফেরত দিলে আমরাই সেখান থেকে যেতে পারব। প্রথম থেকেই তারা এটা বলে আসছিল।’
এফভি লাইলা-২ জাহাজের সেকেন্ড অফিসার সাজেদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘তারা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই আমাদের ধরে নিয়ে গেছে। কিছু হলেই তো বুঝা যায়। ধরার পর পরই তারা আমাদের বলেছে, তাদের কিছু লোক আমাদের দেশে আটক আছে। তাদের ছাড়ানোর কোনো দিক পাচ্ছিল না। তাই ফাঁদে ফেলে আমাদের আটক করে তাদের ছাড়িয়ে নিয়েছে। মাঝখানে আমরা হয়ে গেছি বলির পাঠা।’
এফবি লাইলা-২ জাহাজের গ্রীজার মঈনউদ্দিন রানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের জোর করে নিয়ে গেছে। আমরা তো ইন্ডিয়ার বর্ডারে ফিশিং করেনি। আমরা আমাদের বর্ডারেই ছিলাম। আমাদের ডেকে ওরা নিয়ে গেছে। চেক করে আবার ছেড়ে দিয়েছে। এক ঘণ্টা পর তারা বার্তা পাঠিয়ে বলে, আমাদের আইফোন পড়ে গেছে। সেটা চেক করার জন্য আবার আপনাদের জাহাজে তল্লাশি করতে হবে। আপনারা আমাদের বর্ডারে আসেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ক্যাপ্টেন তো আর অত কিছু ভাবেনি যে, গেলে তারা ধরে ফেলবে। কারণ, তারা প্রথমে চেক করে ছেড়ে দিয়েছে। এর পর আমাদের বোটকে তারা নির্দেশ দেয় পশ্চিম দিকে চালাতে। তারপর আমাদের কোস্টগার্ডের আরেকটি টিমের কাছে হস্তান্তর করে। পরে তারা আমাদের উড়িষ্যার প্যারাদ্বীপ বন্দরে নিয়ে যায়। ওখানে নিয়ে যাওয়ার পর বুঝি আমরা ভারতে চলে আসছি। আমাদের জাহাজে প্রায় এক কোটি টাকার মাছ ছিল। ওসব ঠিক আছে। ওরা সেগুলোতে হাত দেয়নি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোস্টগার্ডের পূর্বজোনের জোনাল কমান্ডার জহিরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘অভিযোগ ছিল তারা ভারতীয় সীমানায় মাছ ধরছিল। সেজন্য তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারা এসেছে। এ বিষয়ে পুলিশকে অবগত করা হয়েছে। আমরা যাচাই করে দেখব বিষয়টি। উনারা বলেছেন, জেলেরা তাদের সীমানায় চলে গেছে; সেটা সঠিক, নাকি তারা আমাদের সীমানায় চলে এসেছে সেটা। আমরা যাচাই করছি।’
বাংলাদেশে আটক ভারতীয় জেলেদের মুক্ত করতেই এ ঘটনা কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনো বলা যাচ্ছে না কিছু। আমাদের এখানেও তাদের কিছু জেলে আটক ছিল, আবার তাদের ওখানে আমাদেরও ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে এ বিনিময় হয়েছে।’
‘মনে হচ্ছে, ৫ বছর পর ছেলেকে পেয়েছি’
ভারতের কোস্টগার্ডের হাতে আটক এফবি লাইলা-২ জাহাজে লস্কর হিসেবে কাজ করতেন কুমিল্লার গৌরপুর উপজেলার মো. ফেরদৌস। পরিবার নিয়ে থাকতেন নগরীর পাহাড়তলী এলাকায়। গত ৯ ডিসেম্বর ভারতে আটক হওয়ার পর থেকে ফেরদৌসের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছিলেন না মা হাসিনা বেগম। সরকার ও প্রশাসনের কাছে ধর্ণা দিয়েও কিছুই করতে পারছিলেন না। তাই ২৪ দিন পর বুকের ধনকে কাছে পেয়েই কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকেন হাসিনা বেগম।
হাসিনা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার তো মনে হচ্ছে, পাঁচ বছর পর ছেলেকে পেয়েছি। আমাদের একদিন এক বছরের মতো গেছে। ওকে যখন আটক করার খবর পাই, তখন মনে হচ্ছিল আদৌ ও ফিরে আসবে কি না। এ রকম অনেক কিছু মনে হয়েছে। যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও করতে পারিনি। এ কয়েকদিন শুধু আল্লাহকে ডেকেছি। সবার সহযোগিতায় আমি আমি আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি।’
বিনা অপরাধেই ভারতীয় কোস্টগার্ড আটক করেছে অভিযোগ করে ফেরদৌস সারাবাংলাকে বলেন, ‘২৯ দিন পর মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমাদের বিনা অপরাধে নিয়ে গেছে। যদি অপরাধ করতাম, তাহলে নিয়ে গেলে মনকে বুঝ দিতে পারতাম। ভারতে ২৫ দিন আমরা ছিলাম। আমরা তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন আমাদের নিয়ে আসা হয়েছে। তারা আমাদের বলেছে, মন্ত্রণালয় থেকে নাকি কল আসছে আমাদের আটক করার জন্য।’
তিনি বলেন, ‘তাদের ৯৫ জন জেলে নাকি বাংলাদেশে আটক আছেন। তাদের ছাড়া হলেই নাকি আমাদের ছেড়ে দেবে। আমাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। ওখানে আমরা জেলে ছিলাম না ঠিক। কিন্তু জাহাজ জেলেই ছিলাম। কোনো জায়গায় যেতে পারিনি। জাহাজের মধ্যেই সব কাজ করতে হয়েছে।’
সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম