‘দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে রক্তের বিনিময়ে হলেও চাঁদাবাজি বন্ধ করব’
১৭ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:০৩ | আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:১৩
ঢাকা: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে দেশে ইনসাফ ভিত্তিক উন্নয়ন হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, কথা দিচ্ছি আপনাদের খেদমতের দায়িত্ব পেলে ন্যায্য দাবিগুলো চাওয়া ছাড়াই বাস্তবায়ন করা হবে। কথা দিচ্ছি রক্তের বিনিময়ে হলেও দেশে চাঁদাবাজি বন্ধ করব। জুলুমবাজি থাকবে না। দখলবাজিও থাকবে না। আমাদের সন্তানদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতে চাই ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ শেষ হয়নি যুদ্ধ’।
শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) চুয়াডাঙ্গা জেলার টাউনহল ফুটবল মাঠে ঐতিহাসিক কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখা এই সম্মেলনের আয়োজন করে। জেলা আমীর মো. রুহুল আমিনের সভাপতিত্বে জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামানের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চল পরিচালক জনাব মোবারক হোসাইন। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন চুয়াডাঙ্গা জেলা জামায়াতের সাবেক আমির আনোয়ারুল হক মালিক, নায়েবে আমির মাওলানা আজিজুর রহমান, জেলা সহকারী সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ রাসেল, মো আব্দুল কাদের, জেলার দলিত পরিষদ নেতা শোভন দাস, জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক আসলাম অর্ক, ছাত্র শিবিরের জেলা সভাপতি সাগর আহমেদ, শহিদ শুভর গর্বিত পিতা মো. আবু সঈদ মন্ডল। এর আগে মাওলানা মহি উদ্দীনের অর্থসহ কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে কর্মী সম্মেলন শুরু হয়।
চুয়াডাঙ্গায় আগমন নিয়ে আমিরে জামায়াত বলেন, ‘দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ১৫ বছর আমরা কথা বলতে পারিনি। চুয়াডাঙ্গাতে এসেছি দফায় দফায়। কাজ করেছি চুপি চুপি। চলে যেতে হয়েছে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। কারণ হচ্ছে ফ্যাসিবাদ এই জাতিকে আঁকড়ে রেখেছিল। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে কোথাও শান্তিতে দাঁড়াতে দেয়নি।’
তিনি আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘নেত্রকোনায় একটি বাড়িতে, বাপবেটা দুপুরের খাবার খাচ্ছিল। বাবা জামায়াতে ইসলামীর কর্মী আর ছেলে ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী। দুইজনকে ধরে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীর মামলা দেয়। আমাদের ভাত খাওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এরা সাড়ে ১৫ বছর দেশকে ইচ্ছে মত চালিয়েছে। স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষের কথা বলে দেশ ও জাতিকে বিভক্ত করেছে। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিভক্তি টেনেছে। এক এক করে আমাদের ১১ জন নেতাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কবরস্থান, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, রোড-কালর্ভাট সবকিছু থেকে পারসেনটিসের নামে লুণ্ঠন করা হয়েছে। লুণ্ঠন করার পর তারা পালিয়ে গেছে। তারা এমন লুটপাট করেছে যে এখন দেশের মানুষের সামনে মুখ দেখানোর সাহস পাচ্ছে না। আমরা তাদের বলি ফিরে আসেন। আমরা আপনাদের বিচারটা দেখতে চাই। কারণ আপনারা এ দেশের বিরোধী দলের দেশপ্রেমিক নেতাকর্মী, নিরীহ মানুষ আলেম ওলামাদের ধরে নিয়ে গুম করেছেন। বিচারের নামে প্রহসন করে তাদের দুনিয়া থেকে বিদায় করেছেন। আপনারা তখন বলেছেন আমরা কিছু করি নাই। আদালত সবকিছু করেছে। আমরাও আপনাদের আদালতে সোপর্দ করতে চাই। ফিরে আসেন, যদি এই দেশ এবং মাটির প্রতি ভালবাসা থাকে। জনগণ আপনাদের কাশিমপুরে ভাল করে থাকার ব্যবস্থা করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরা আমাদের স্কুল কলেজ শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। আমাদের উন্নয়নকে আপানারা লুটেরাদের হাতে তুলে দিলেন। দেশ থেকে ২৬ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করলেন। ’
তিনি নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘আমরা দেশবাসী শুধু জামায়াতে ইসলামী নয়, দেশের আপামর জনগণ জাতি ধর্ম দলমত নির্বিশেষে এ দেশে যাদের জন্ম হয়েছে। দেশটাকে যারা ভালবাসে, আমরা সবাই মিলে দেশটাকে গড়তে চাই। এরা দেশটাকে কঙ্কাল বানিয়েছে তাতে আমরা গোশত এবং চামড়া মোড়াতে চাই। ওরা উন্নয়নের নামে লুটতরাজ করেছিল, আমরা ইনসাফভিত্তিক উন্নয়ন উপহার দিতে চাই।’
তিনি চুয়াডাঙ্গাকে বঞ্চিত জেলা অভিহিত করে বলেন, ‘এখানে একটা মেডিকেল কলেজ হওয়া দরকার সবার আগে। কারণ সুস্থতার জন্য চিকিৎসা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’
তিনি চুয়াডাঙ্গাবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘আমাদের দল যদি দেশ পরিচালনা করার দায়িত্ব পায়, তাহলে কথা দিচ্ছি, ইনসাফের কারণে আপনাদের দাবি পূরণ করা হবে। দেশের মালিক না হয়ে সেবকে পরিণত হবো।’
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘দুর্নীতি আর দুঃশাসন একটা আরেকটার পরিপূরক। যেখান দুঃশাসন আছে সেখানে দুর্নীতি থাকবেই। চুয়াডাঙ্গাবাসীকে বলেন, ‘মনে হয় এখানে দুর্নীতি নাই। কেউ চঁদাবাজি করে না। দখলবাজ এখানে নাই। মাঠ থেকে জবাব আসে এখানেও চাঁদাবাজ দখলদার আছে।
তিনি বলেন, ‘এজন্য কি আমাদের সন্তানেরা জীবন দিয়েছে? তাদের রক্তের ওপর দিয়ে দখলবাজি চলবে? নিরীহ মানুষকে আসামি বানিয়ে বাণিজ্য চলবে? তাদের একটাই চাওয়া ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। আমরা ন্যায় বিচার চাই। বৈষম্য চাই না। সেই বাংলাদেশ কায়েম হয়নি বলেই আমাদের সন্তানরা আবারো স্লোগান তুলেছে ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ শেষ হয়নি যুদ্ধ।’ একটা মানবিক বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামবো না। আমরা কারো রক্তচুক্ষু পরওয়া করি না। আমরা পরওয়া করি শুধু পরওয়ার দিগার আল্লাহতায়ালাকে। হাজার বছর বেঁচে থাকার চেয়ে একটা শ্বাস সিংহের মতো নিতে চাই। আমরা সবাইকে বলি আরেকটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। খারাপ ফুলের গাছ কাটা পড়েছে। কিন্তু আগাছা রয়ে গেছে। এইগুলো পরিষ্কার করবো ইনশাআল্লাহ।’
ডা. শফিকুর রহমান একটি গ্রাফিতির গভীরতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আমাদের সন্তানেরা পুরোটা আন্দোলনের সময় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। তারা বলেছে আমাদের রক্ত গরম, মাথা ঠান্ডা।’
আমাদের সন্তানেরা রক্ত দিয়ে যেহেতু তৃতীয় স্বাধীনতা এনে দিয়েছে ইনশাআল্লাহ আমরা রক্ত দিয়ে সেই স্বাধীনতা রক্ষা করব। সন্তানদের স্লোগান বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের জীবন যায় যাবে। আমাদের আন্দোলন ছাড়ব না।
তিনি রাজনৈতিক বন্ধুদের দেশটাকে ভালবাসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বলুন আজ থেকে আর চাঁদাবাজি করব না। দখলবাণিজ্য চালাবো না। ঘুষ খাবো না। মানুষকে ভয়ভীতি দেখাব না। কারো ইজ্জত লুটপাাট করব না। যখন তখন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করব না।’
এর আগে তিনি সমাবেশ স্থলে জুমআর নামাজের আলোচনা রাখেন এবং তার ইমামতিত্বে লাখো নেতাকর্মী জুমাআর নামাজ আদায় করেন। এর আগে সকালে মহিলা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
কর্মী সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য মোবারক হোসাইন বলেন, ‘২৪ এর জনস্রোত এমনি এমনি আসেনি। এজন্য আমাদের রাহবারগণ জীবন দিয়েছেন। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আমরা একটি ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ গড়তে চাই। দুর্নীতিবিহীন দেশ গড়তে চাই। এজন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। তিনি জামায়াতের দেওয়া ৪১ দফা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে বলেন দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘এতদিন চুয়াডাঙ্গায় কেবল রাক্ষসের শাসন চলেছে। এবার আমরা চুয়াডাঙ্গাকে নতুন করে গড়তে চাই।’
কর্মী সম্মেলন শুরুর আগেই সম্মেলনস্থল কানায় কানায় ভরে যায়। নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় পুরো চুয়াডাঙ্গা শহর। কর্মী সম্মেলন উপলক্ষ্যে পুরো চুয়াডাঙ্গাকে বিলবোর্ড, তোরণ, ব্যানার, ফেস্টুন ব্যানার দিয়ে পুরো বর্ণাঢ্য সাজে সাজানো হয়। ফলে চুয়াডাঙ্গাজুড়ে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। কিছুক্ষণ পর পর নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত হয় পুরো চুয়াডাঙ্গা শহর।
সারাবাংলা/জিএস/ এইচআই