মাইকেল মধুসূদন দত্তের ২০১তম জন্মবার্ষিকী আজ
২৫ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:২৬ | আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৪৫
‘সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।
সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।’..
বাংলা সাহিত্যের সনেট ও মহাকাব্যের স্রষ্টা কবি খ্যাত প্রবাদ প্রতীম মহাপুরুষ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ২০১তম জন্মবার্ষিকী আজ (২৫ জানুয়ারি)। ১৮২৪ সালের এই দিনে তিনি যশোরের সাগরদাঁড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর যশোরের কেশবপুরে তার জন্মস্থান সাগরদাঁড়িতে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে সাত দিনব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এবারও সেই ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে মধুমেলা। মেলার মূল মঞ্চে প্রতিদিন আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষের পদচারণায় মিলন মেলায় পরিণত হয় এলাকাটি। তাছাড়া যাত্রা, সার্কাস, গ্রামীণ খেলাধূলা, পণ্য পশরার দোকান, পোশাক, ফুলের দোকান, হরেক রকম খাবারের দোকান বসে। মানুষের কর্মব্যস্ত দিনের ছক ভেঙে আনন্দের অনুষঙ্গময় দিনে পরিণত হয়।
সাতদিন ব্যাপী এ মেলা শেষ হবে আগামি ৩০ জানুয়ারি। আয়োজক জেলা প্রশাসনের পক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা আয়োজনের দায়িত্বে থাকা ডিডিএলজি রফিকুল হাসান জানান, এবারও মেলার আয়োজন বেশ ভালো। কোনো ঝামেলা নেই। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক। অন্যবারের চেয়ে এবার মেলা অধিক গ্রহণযোগ্য ও চমৎকার।
জমিদার রাজনারায়ণ দত্ত ও জাহ্নবী দেবীর সন্তান মধুসূদন দত্ত ছোটবেলা থেকেই অতি আদর ও বড্ড বাড়বাড়িতে বেড়ে ওঠেন। যা চাই তাই করতে হবে এমন দূরন্তপনা নিয়ে চলা মধুকে ৭ বছর বয়সে কলকাতায় চলে যেতে হয়। বড় কবি হতে চেয়েছিলেন, বিখ্যাত হতে চেয়েছিলেন। ধর্ম ত্যাগ, বাংলাভাষাকে অবজ্ঞা, বিদেশে বসবাস। তারপরও ইংরেজি ভাষায় লেখা তার সাহিত্যকে অবজ্ঞা করল সেই বিদেশিরাই। জীবনের এক পর্যায়ে ফিরে এলেন কলকাতায়। লিখলেন বাংলা ভাষায় মহাকাব্য, প্রহসন, সনেট। সাহিত্যকে দেব-দেবীর আসন থেকে তুলে এনে দিলেন মানবিকতার ঘরে। মানুষের প্রেম, দেশপ্রেম, জাতীয়তা, নারীর অধিকার, তুলে ধরলেন সমাজের উঁচু স্তরের মানুষের চরিত্র। বাংলা সাহিত্যর প্রথম বিদ্রোহী তিনি। বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে স্থান করে দিলেন বিশ্বে। পাশ্চাত্য ভাবধারাকে ধারণ করে স্থান দিলেন বাংলা ভাষায় নতুন রূপে। হলেন সমাদৃত।
যদিও বাংলাভাষায় তিনি মাত্র সাত বছর সময় দিয়েছেন, তবু পৌনে দুইশ বছর পরও বাংলা সাহিত্যে তিনি এখনো প্রাাসঙ্গিক। তাই এখনো তিনি সমাদৃত। তার কালজয়ী মহাকাব্য মেঘনাদ বধ তাকে দিয়েছে অমূল্য সম্মান। মহাকাব্যটির রচনাকাল ১৮৬১। মূল ‘রামায়ণ’ রচনা করেছেন বাল্মীকি। আর বাংলায় প্রচলিত কৃত্তিবাসী ‘রামায়ণ’। দুই রামায়ণেই রামকে দেবতারূপে পূজনীয় করে তোলা হয়েছে। কিন্তু মাইকেল ‘মেঘনাদবধকাব্যে’ রামকে দেবতা বলে স্বীকার করেননি। বরং কাব্যের বর্ণনায় তিনি রামকে নয়, বরং রাবণের পক্ষে কথা বলেছেন। তাতে তিনি রাবণকে নায়কোচিত রূপ দিয়েছেন।
আবহমান বাঙালির মন ও মননকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কারণ তার ‘মেঘনাদবধকাব্য’ প্রচলিত কাহিনির গণ্ডি পেরিয়ে এক নতুন ধারা নির্মাণ করে। তিনি প্রথা ও চেতনাকে ভাঙার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। কারণ কৃত্তিবাসী বা বাল্মীকির রামায়ণে রাম দেবতা। কিন্তু মধুসূদন দত্ত নতুন যুগের নতুন ভাবনার মানুষ। ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীভুক্ত। এসব চেতনাকে কাজে লাগিয়ে তিনি রামায়ণের কাহিনি থেকে মূল চেতনাকে গ্রহণ করলেও আধুনিক মানুষ ও সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তিনি রামকে দেবত্ব আরোপ করেননি। কারণ আধুনিক মানুষের বৈশিষ্ট্য মানবতাবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটানো।
অমর সৃষ্টি মহাকাব্য ছাড়াও পত্র কাব্য, সনেট, প্রহসন, চর্তুদশপদী কবিতা, অমিত্রাক্ষর কাব্য ও কবিতা তাকে অমর করে রেখেছে। তবে এই মহাকবির নাট্য চর্চাও তাকে দিয়েছে নতুনত্ব ও খ্যাতি। তিনি প্রহসন রচনা করেন এবং তা সে সময়ে কলকাতার বেলগাছিয়া মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়। নাট্যচর্চার কাল ও রচিত নাটকের সংখ্যা দুই-ই সীমিত। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬১ এই তিন বছর তিনি নাট্যচর্চা করেন। এই সময়ে তার রচিত নাটকগুলো হলো- শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯), একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০), পদ্মাবতী (১৮৬০), কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১)
সারাবাংলা/পিটিএম