Saturday 01 Feb 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফুলের হাতে ফুল
স্যার ফুল নেন, টাকা দেন, মজা খামু!

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:০০ | আপডেট: ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:০৫

ফুলের মতো শিশুদের হাতেই ফুল। শখ করে নয়, এ ফুল বিক্রির জন্য। ছবি: সারাবাংলা

ঢাকা: রমনায় প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণে গেলে দেখা মেলে ছোট্ট শিশু মরিয়ম, আকলিমা, রহিমা ও আসমার সঙ্গে। ওরা আমাকে দেখলেই দৌড়ে কাছে আসে একটি গোলাপ বা বেলি ফুলের মালা নিয়ে। হাসি মুখে বলে- ‘স্যার একটা মালা বা ফুল নেন, টাকা দেন, মজা খামু’। কেউ বলে, ‘খিদা লাগছে, রুটি খামু’। ওদের মিষ্টি হাসিমাখা চেহারা দেখলেই মনে হয়, ওরা যেন নিজেরাই এক একটি ফুল।

এভাবেই প্রতিদিন রমনায় প্রাতঃভ্রমণকারীদের কাছে ছুটে যায় ছোট্ট শিশুরা। কেউ ফুল নিয়ে ১০ টাকা, আবার কেউ ২০ টাকা দেয়। কেউ আবার ১০০ টাকা দিয়েও ফুল নিয়ে চলে যায়। রমনা পার্কে ভেতরে রানীর মাঠ, মৎস্য ভবনসংলগ্ন রমনা গেইটের সামনে ও অশ্বচল গেইটের ওদের দেখা মেলে। কাক ডাকা ভোরে রমনার গেইটে তারা আসে। সারাদিন ফুল বিক্রি করে সন্ধ্যায় চলে যায়।

বিজ্ঞাপন
ফুলের হাতে ফুল। আবার সেই ফুলই বিক্রি হবে। ছবি: সারাবাংলা

ফুলের হাতে ফুল। আবার সেই ফুলই বিক্রি হবে। ছবি: সারাবাংলা

মরিয়ম, আকলিমা, রহিমা ও আসমার বাড়ি নেত্রকোনা। বাবা মায়ের সঙ্গে থাকে মগবাজার বস্তিতে। ফুল বিক্রি করতে প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে এলেও বেলা ১১টায় পাউরুটি কিংবা অন্য কিছু খায় তারা। দুপুরে প্রায় দিনেই না খেয়ে থাকে। ঘুরতে আসা লোকজন যদি কিছু দেয় তা হলে তাহলে খায়। রাতে একবারে বস্তিতে গিয়ে ভাত খায়। এই ছোট্ট শিশুরা জানায়, গত কোরবানি ঈদে সর্বশেষ তারা গরুর মাংস খেয়েছে। মাসে একবার বা দুইবার মাছ দিয়ে ভাত খায় তারা। সবসময় সবজি দিয়ে ভাতই জোটে তাদের কপালে।

ফুল বিক্রি করলেও তাদের মন পড়ে থাকে বইয়ের ভেতর। লেখাপড়া শেখার প্রবল ইচ্ছে তাদের। কিন্তু আর্থিক অনটন ও পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে স্কুলে ভর্তি হতে পারে না। মরিয়ম, আকলিমা, রহিমা ও আসমার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুল বিক্রি করে তারা কোনো কোনো দিন পাঁচশ থেকে সাতশ, আবার কোনো সময় একশ থেকে তিনশ টাকাও আয় করে। ফুল বিক্রি করতে গিয়ে অনেক সময় ক্রেতাদের কাছ থেকে ধমক খায়। কেউ আবার কেউ চড়-থাপ্পরও মারে। কেউ কাজের জন্য বাসায় নিতে চায়। কেউবা খারাপ কথা বলে।

বিজ্ঞাপন
ফুল নেন, টাকা দেন। এভাবেই মানুষের সামনে বাড়িয়ে দেয় গোলাপ অথবা বেলি। ছবি: সারাবাংলা

ফুল নেন, টাকা দেন। এভাবেই মানুষের সামনে বাড়িয়ে দেয় গোলাপ অথবা বেলি। ছবি: সারাবাংলা

ফুলের মতো শিশুদের হাতেই ফুল। শখ করে নয়, এ ফুল বিক্রির জন্য রাজপথে, রমনায় দাঁড়িয়ে থাকে। রাজধানীর সড়কে ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামলেই যাত্রীর সামনে আবদার- ‘একটা ফুল নেন স্যার।’ জীবন-বাস্তবতায় এসব শিশুকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই নামতে হয়েছে উপার্জনে। কারও হাতে গোলাপ, কারও হাতে বেলি ফুলের মালা।

শাহবাগের ফুল বাজার থেকে চেয়ে কিংবা কুড়িয়ে আনা ফুলই এসব শিশু বিক্রির জন্য বেছে নেয়। কেউ ফুল নেয়, কেউবা ফিরেও তাকায় না। কেউ কেউ আছেন তুলে দেন অতিরিক্ত টাকা। এভাবেই এসব শিশু উপার্জন করে বাবা-মার হাতে তুলে দিচ্ছে অর্থ। যা তাদের সংসার চালাতে কাজে লাগছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন সিগন্যাল ও পার্কে বিশেষ করে বিজয় সরণি, ফার্মগেট, পান্থপথ, খামারবাড়ি, সংসদ ভবনের সামনে, বসুন্ধরা শপিং মল, শাহবাগ, গুলিস্তান, টিএসটি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ধানমন্ডি ৩২, রমনা পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ বিভিন্ন স্থানে হাতে নিয়ে ফুল বিক্রি করতে দেখা যায় অনেক শিশুকে। এদের অধিকাংশই পথশিশু ও উদ্বাস্তু। যাদের অনেকের বাবা আছে তো মা নেই, মা আছে তো বাবা নেই। আবার অনেকের বাবা-মা কেউ-ই নেই।

শাহবাগের ফুল বাজার থেকে চেয়ে কিংবা কুড়িয়ে আনা ফুলই এসব শিশু বিক্রির জন্য বেছে নেয়। ছবি: সারাবাংলা

শাহবাগের ফুল বাজার থেকে চেয়ে কিংবা কুড়িয়ে আনা ফুলই এসব শিশু বিক্রির জন্য বেছে নেয়

২০২৪ সালের ইউনিসেফের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে পথে বসবাসরত শিশুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৫ লাখ। যাদের ৭০ ভাগই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় প্রতিনিয়তই এই শিশুদের দেখা মেলে, কিন্তু তদের সংগ্রামমুখর জীবন অনেকের কাছেই থেকে যায় অজানা। অসহায় এই শিশুদের জীবনে নিত্য সঙ্গী হলো অবহেলা ও নির্যাতন।

জানা গেছে, শিশুদের সংগ্রামমুখর জীবনের ট্রমা তাদের বেঁচে থাকাকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে। দৈনন্দিন এই সংগ্রামের ফলে তাদের মনে তৈরি হওয়া গভীর ক্ষত পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের সৃষ্টি করে। এসব ট্রমা থেকে বাঁচতে সাময়িক মুক্তির জন্য তারা নিজেদের ঠেলে দেয় বিপদে। ট্রমা থেকে মুক্তি পেতে বেশিরভাগ শিশু নেশায় জড়িয়ে পড়ে। আবার অনেক সময় এসব পথশিশুরা ধর্ষণেরও শিকার হয়। সম্প্রতি রাজধানীর শাহবাগে মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে ফুল বিক্রেতা এক শিশুকে ধর্ষণ করে ১৯ বছরের এক যুবক।

শিশুদের সংগ্রামমুখর জীবনের ট্রমা তাদের বেঁচে থাকাকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে। ছবি: সারাবাংলা

শিশুদের সংগ্রামমুখর জীবনের ট্রমা তাদের বেঁচে থাকাকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে। ছবি: সারাবাংলা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে কিছু ‍কিছু জায়গায় পথশিশুদের নিয়ে কাজ হচ্ছে। তবে এই প্রক্রিয়ায় তাদের মৌলিক বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি এখনো অবহেলিত ও উপেক্ষিত। পথশিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে যথাযথ গবেষণা করে তাদের সঠিক চিকিৎসা দিয়ে সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসা উচিত।

সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম

পথশিশু ফুল বিক্রেতা রমনা

বিজ্ঞাপন

খুলনায় সড়ক দুর্ঘটনায় ২ যুবক নিহত
১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:০৪

আরো

সম্পর্কিত খবর