জল থৈ থৈ ছয় মাস, ছয় মাস ফসলের ঘ্রাণ
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৮:১৫
সুনামগঞ্জ: মধ্যনগর উপজেলার গোরমার হাওরের পাড়ে একটি গ্রামের নাম মুকসুদপুর। কাগজে কলমে উপজেলার চামরদানী ইউনিয়নের একটি গ্রাম হিসেবে মুকসুদপুরকে গ্রাম বলা হলেও আদতে সেখানে ছয় মাস কোনো জনবসতি থাকে না। প্রতিবছর বর্ষাকালের ছয়মাস হাওরের অথৈ জলের নিচে থাকে এই গ্রামের অস্তিত্ব।
তবে প্রতি বোরো মৌসুমে জমজমাট এক জনবসতির দেখা মিলে গ্রামটিতে। ছয় মাস কৃষিকাজে ব্যস্ত জীবন কাটিয়ে সোনালি ফসল নিয়ে বাড়ি ফেরেন গ্রামের বাসিন্দারা। তাদের এই কষ্টের মাধ্যমে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। ছয় মাসের বাসিন্দা এই মুকসুদপুর গ্রামের কৃষকদের স্থানীয়রা ‘জিরাতি’ বলে থাকেন। তারা শুধুমাত্র ফসল উৎপাদনের জন্য বছরের একটি বড় সময় নিজের পরিবার ও পরিজনদের ছেড়ে অস্থায়ীভাবে গোরমার হাওরে থাকেন।
হাওরের কান্দায় জিরাতিদের ঘরগুলো আদতে কুঁড়েঘর। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, বিস্তীর্ণ সবুজের বুকে শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো একটি কৃষি শ্রমিকদের বসতি। মুকসুদপুরের জিরাতিরা প্রতি বছরই কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে বাঁশের বেড়া আর ছন দিয়ে ছাওয়া এসব ঘর তৈরি করেন। তবে হাওরে খাদ্য উৎপাদন ও পশু পালনের মাধ্যমে কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা জিরাতিদের অবস্থা এখন আগের মতো নেই। তাদের কথা ভাবার জন্য যেন নেই কেউ। তবুও হাওরের সঙ্গেই এসব জিরাতিদের গভীর হৃদ্যতা-সখ্য। আর এ কারণেই তারা ঘরও বাঁধেন হাওরপাড়েই ছয় মাসের জন্য। ছন দিয়ে ছাওয়া অস্থায়ী ঘরেই থাকেন স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে। খরতাপ, রোদে পোড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে মানুষসহ গরু, ছাগল, প্রাণী। তবুও গোটা বছরের একমাত্র সম্বল বোরো ফসল ফলিয়ে গন্তব্যে ফেরেন বৈশাখ মাসে।
জানা গেছে, পাকিস্তান শাসন আমলে মুকসুদপুর সমৃদ্ধশালী কৃষকদের গ্রাম ছিল। এই গ্রামে হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে কয়েকশ গৃহস্থ পরিবার বসবাস করতো। সবার মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় ছিল। শুষ্ক মৌসুমে হাওরে ফসল উৎপাদন ও ভরা বর্ষায় হাওরে মাছ ধরে চলতো গ্রামবাসীর জীবন। বছরের পর বছর পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট অকাল বন্যায় ফসল হারিয়ে ও হাওরের টেউয়ের আঘাতে গ্রামের বাড়িঘর ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি ছিল ডাকাতের উপদ্রব। ফলে মুকসুদপুর গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দারা জীবিকার তাগিদে শূন্যহাতে উপজেলার বংশীকুন্ডা উত্তর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী অঞ্চল বাকাতলা গ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। রয়ে যায় তাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি আর হাওরের বুকে শত শত একর ফসলি জমি।
মুকসুদপুর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, বছর তিনেক ধরে ফসলের মুখ দেখলেও এর আগে একযুগ প্রায় আগাম পাহাড়ি ঢল এসে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে জিরাতিদেরও সর্বস্বান্ত করে ফেলেছিল। তাই গুরমার হাওরে জিরাতিদের আসা অনেকটাই কমেছে। একসময় স্বামী-সন্তানদের নিয়ে মুকসুদপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা গীতা রাণী সরকার। হাওরে কৃষি কাজে পরিবারের লোকদের সহায়তা করার জন্য জিরাতি হয়ে মুকসুদপুরে এই বছর এসেছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের আগে স্বামীসন্তানদের লইয়া মুকসুদপুর গ্রামে বসবাস করতাম। শুকনো মৌসুমে হাওরে বোরো ফসল ফলাইয়া ও ভাইস্যার (বর্ষাকালে) সময় হাওরে মাছ ধইরা যে রোজগার হইতো তা দিয়া সংসারের খরচ চলতো। সংগ্রামের সময় ধীরে ধীরে গ্রামটি হাওরের টেউয়ের আঘাতে ভাইঙা তছনছ হয়ে যায়। আর প্রতি বছর হানা দিত ডাকাতের দল। লুট করে নিয়ে নিয়ে যেত সর্বস্ব। পরে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে ভারত সীমান্তবর্তী বাকাতলা গ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করি। সেই থেকেই মুকসুদপুর শুধু নামই রইল, গ্রামটি হারিয়ে গেল হাওরের বুকে। অবশ্য ছেড়ে যাওয়ার কয়েক বছর পর থেকেই তারা জিরাতি হিসেবে মুকসুদপুরে আসতে শুরু করেন। তবে স্থায়ী বসতি স্থাপনের চিন্তা আর করেনি কেউ।’
মুকসুদপুরের জিরাতি আরেক বাসিন্দা কৃষক শংকর সরকার বলেন, ‘প্রতিবছর হাওরে জমিজমা চাষ করতে আইসা ছয়মাসের মতন হাওরে জিরাত করা লাগে। এই সময় আমরা সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাবে নানা রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত হই। পরিবারের ছোট শিশুরা বছরে ছয়মাস পড়ালেখা করতে পারে না। এখানে কোনো বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় কুপি বাতি অথবা সোলার প্যানেল ব্যবহার করে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা হয়। আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো হাটবাজার না থাকায় সপ্তাহের প্রতি শনিবার ২০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে মধ্যনগর বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হয়।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে শংকর বলেন, ‘বাপ-দাদার জমি ছাইড়া যাইতে মন চায় না। তাই প্রতিবছর এমন সময়ে এখানে আসি। জিরাত করে যাই, পাই তাই লইয়া বাড়িতে যাই।
মুকসুদপুরের জিরাতিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বোরো মৌসুমে জিরাতিরা হাওরে ফসল ফলাতে এসে নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হন। এতে দেখা যায় অকাল বন্যায় হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে ফসল ডুবে গেলে জিরাতিদের স্বপ্ন ভেঙে যায়। মাথার উপরে ঋণের বোঝা নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়। ভালো ফলনে বুক ভরা আশা নিয়ে সারাবছর পরিশ্রম করেন তারা।
যুগের পর যুগ শত দুঃখ কষ্টে এভাবেই চলছে জিরাতিদের জীবনযাপন। তাদের আদিপুরুষ থেকে বংশ পরম্পরা এভাবেই চালাচ্ছেন নিজেদের চাষাবাদ। জিরাতকালে তাদের সুপেয় পানীয়জল, স্যানিটেশন ল্যাট্রিন, শিশুদের পড়াশোনার জন্য কমিউনিটি স্কুল স্থাপনাসহ সকল ধরনের নাগরিক জীবনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হলে দেশের খাদ্য উৎপাদনের জন্য তারা আরো বেশি অবদান রাখতে পারবে।
তারা জানান, বছর দশেক আগে জিরাতিরা ধানের আবাদ বা কাটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। পুষ্টির জোগান কিংবা বাড়তি আয় করতে হাওরে নেমে পড়তেন মাছ ধরায়। ছোট ছোট নৌকায় রাতভর মাছ ধরতেন। নগদ টাকা পকেটে ভরে খুশিমনে অস্থায়ী ডেরায় ফিরতেন। এখন আর আগের অবস্থা নেই সবটুকু জলে ইজারাদারের এখন একচ্ছত্র আধিপত্য। একটি চুনোপুঁটিও ধরার সুযোগ নেই আর।
তারা আরও জানান, ইজারাদারের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় হাওরে আগের মতো মাছ ধরার সুযোগ নেই। ফলে পরিবারের সদস্যদের আমিষের ঘাটতি পূরণ করা যায় না। দিন দিন এসব সংকট বাড়ছে। তাই আগের মতো জিরাতিরা আসছে না। এতে অনেক জমি পতিত থেকে যাচ্ছে প্রতি বছর।
মধ্যনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজ্জ্বল রায় বললেন, ‘জিরাতিরা আমাদের দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেন। কিন্তু তারা রাষ্ট্র ও সমাজের কাছ থেকে তেমন সুযোগ-সুবিধা পান না। সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে মুকসুদপুরের জিরাতিদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হবে। তাদের জীবনমানের উন্নয়নে উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/পিটিএম