কৃষিজমি রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:০৯
ঢাকা: সারাদেশে মানবিক ডিসি হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা এবার জেলার কৃষিজমি রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নিলেন।
দেশে খাদ্য ঘাটতি দূর করার লক্ষ্যে জেলার সব দুই ফসলী জমিকে তিন ফসলী জমিতে রুপান্তরিত করতে বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) স্থানীয় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করলেন আড়াইহাজার উপজেলার হাইজাদী ইউনিয়নের সরাবদী গ্রামে অনুষ্ঠিত এক কৃষক সমাবেশে।
মাত্র দুইটি ফসল ফলানোর পরে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকা জমিগুলোতে আরেকটি ফসল ফলানোর জন্য নতুন পাইলট প্রকল্প চালু করলেন নবাগত জেলা প্রশাসক।
স্থানীয় সরাবদী আইএফএম কৃষক সংগঠনের সভাপতি সফল কৃষক শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বেশিরভাগ জমিতেই দুই ফসল চাষ করতাম। এরপর অনাবাদি থাকত। কিন্তু ডিসি স্যার আজ আমাদের গ্রামে এসে সারা বিশ্বে কৃষি জমি ক্রমাগত কমে যাওয়ার ভয়াবহ প্রভাবে ক্রমবর্ধমান খাদ্য সংকটের কথা জানালেন। উনার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি আমার পুরো জমিতে এখন সবজি চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
একই গ্রামের মো. মকবুল হোসের পুত্র মাসুম আহমেদ বলেন, ‘আমরা আগে খাদ্য ঘাটতির ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আজ ডিসি স্যার নিজে আমার ক্ষেত ঘুরে ঘুরে দেখে আমাকে সবজি চাষের কথা বললেন। সবজি ফলন ভালো হলে আমি আর্থিকভাবেও লাভবান হতে পারব।’
একই এলাকার বিল্লাল হোসেনের পুত্র হৃদয় হোসেন বলেন, ‘ডিসি স্যার আমাদের উন্নতমানে সবজি বীজ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। বীজগুলো পেলেই আমি অনাবাদি জমিতে সবজি চাষ করব। নিজেদের চাহিদা মেটানোর পরে বানিজ্যিকভাবে বিক্রিও করতে পারব।’
এক প্রশ্নের জবাবে তরুণ এই কৃষক বলেন, ‘আগে কোনো ডিসি স্যার আমাদের এভাবে দরদ দিয়ে বুঝিয়ে বলেন নাই। নইলে আরও আগে থেকেই আমি সবজি চাষাবাদ করে লাভবান হতে পারতাম।’
এর আগে নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলার সরাবদী গ্রামের দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরের পাইলট কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা।
সরকারী নীতিমালা অনুযায়ী তিন ফসলি জমি সাধারণত অধিগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় না। তাই তিন ফসলী জমি হিসেবে রুপান্তরিত করায় কৃষকদের কৃষি জমিগুলো নিরাপদ থাকবে।
স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা কৃষি অফিস কর্তৃক আয়োজিত এই কৃষক সমাবেশে কৃষিজ খাদ্য পণ্য উৎপাদনে বিপ্লব সাধনে এই উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে জানা গেছে। অনুষ্ঠান স্থানীয় কৃষকরা জেলা প্রশাসককে গামছা ও কৃষকের ঐতিহ্যবাহী মাথাল পরিয়ে বরণ করে নেন এবং তাদের উৎপাদিত রাসায়নিক সারমুক্ত সবজি উপহার দেন।
বাংলার উর্বর মাটিকে সৃষ্টিকর্তার এক অশেষ উপহার বলে অভিহিত করে জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম তার পূর্বের কর্মস্থল রাজবাড়ী জেলার পলি মাটি পড়ে ফসলি জমি ক্রমে উর্বর হয়ে চার ফসলি জমিতে রূপান্তরের বর্ণনা দেন।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন আগামী দিনে খাদ্যে আমদানি নির্ভরতা কমাতে নারায়ণগঞ্জ জেলার দুই ফসলি জমিকে পর্যায়ক্রমে তিন ফসলিতে রূপান্তর করার। এ চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নের জন্য কৃষক সমাজকে নতুন প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণের আহ্বান জানান। দেশের কৃষিজমি ক্রমে সংকুচিত হয়ে যাওয়ার সমস্যাকে তুলে ধরে কৃষকদের অল্প জমিতে অধিক ফসল ফলানোর আহ্বান জানান জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম।
দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরের শর্তে কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সচিবের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে কৃষকদের সকল প্রকার সাহায্য দেওয়া হবে বলেও তিনি ঘোষণা করেন।
স্থানীয় কৃষকদের খুবই স্মার্ট অভিহিত করে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো কৃষি দিয়েই আমাদের উন্নয়নের যাত্রায় শরিক হতে হবে। তা না হলে ক্রম বর্ধমান চাহিদা মেটাতে ক্রমেই কৃষিপণ্য আমদানি বৃদ্ধি পাবে। এতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ে ঘাটতি দেখা দিবে। তাই এই সমস্যা সমাধানে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তিনি তাগিদ দেন।
কৃষক সমাবেশে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের
উপ-পরিচালক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানব সম্পদ), উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন কৃষি ব্লকের কৃষি কর্মকর্তারা।
নারায়ণগঞ্জ জেলাত পাঁচটি উপজেলার মধ্যে আড়াই হাজার উপজেলার আবাদি জমির পরিমাণ ১১ হাজার ৮১২ হেক্টর, যা নারায়ণগঞ্জ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই উপজেলায় এক ফসলি জমির পরিমাণ ১ হাজার ৬৭৫ হেক্টর, দুই ফসলি জমির পরিমাণ ৮ হাজার ৪৩৭ হেক্টর এবং তিন ফসলি জমির পরিমাণ ১ হাজার ৫৬০ হেক্টর। ফসলের নিবিড়তা ২ দশমিক ০৫। চলমান বোরো মৌসুমে ধানের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৯ হাজার ১৬০ হেক্টর এবং ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪০ হাজার ১৫৭ দশমিক ৭৭ মেট্রিক টন। এই লক্ষমাত্রা অর্জিত হলে শুধু বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধানের সম্ভাব্য বাজার মূল্য হবে প্রায় ৫ হাজার ১৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এ ছাড়া আউশ ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ২ হাজার ৬২ হেক্টর, আমন ধান উৎপাদন লক্ষমাত্রা প্রায় ৩ হাজার ৫৫ হেক্টর জমিতে। এ ছাড়াও এই উপজেলায় চাষাবাদকৃত অন্যান্য ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সবজি ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর। ফসল বৈচিত্র্যের আরও আছে আলু, মিষ্টি আলু, মরিচ, ধনিয়া, মাশকলাই, চিনা বাদাম ইত্যাদি।
এই উপজেলায় কৃষির জন্য বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শিল্পায়ন এবং আবাসন প্রকল্পের কারণে আবাদি কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র কারখানা স্থাপনের ফলে মাটির উর্বরতা ও কৃষি পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়াও এই উপজেলায় কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সত্বেও ক্রম বর্তমান খাদ্য চাহিদার কথা বিবেচনা করে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে উপজেলা কৃষি অফিস নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কৃষক পর্যায়ের সচেতনতা বৃদ্ধি, আধুনিক কলাকৌশল ও প্রযুক্তির সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান, নিয়মিত কৃষকের মাঠ মনিটরিং কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, কৃষক পর্যায়ে সার, বীজ ও কীটনাশকের প্রাপ্যতা ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। এই উপজেলার কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিয়েছে নতুন জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম । আড়াইহাজার উপজেলার দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরের পাইলটিং কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই উপজেলার ৩২ টি কৃষি ব্লকের মধ্যে তিনটি কৃষি ব্লক নির্বাচন করা হয়েছে। নির্বাচিত ব্লক গুলি হলো হাইজাদী ইউনিয়নের হাইজাদি ব্লক, মাহমুদপুর ইউনিয়নের শ্যালমদী ব্লক, বিশনন্দী ইউনিয়নের বিষনন্দী ব্লক। এই বছর এই তিনটি ব্লকে পাইলটিং আকারে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। উক্ত পাইলটিং কর্মসূচির আওতায় লব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে সম্পূর্ণ উপজেলার দুই ফসলের জমি নিয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। হাইজাদি ব্লকের সর্বমোট জমি ৩৩৩ হেক্টর, এর মাঝে দুই ফসলি জমির পরিমাণ ১৮০ হেক্টর। এই দুই ফসলি জমির ৪০ হেক্টর টার্গেট করা হয়েছে। শালমদি ব্লকে সর্বমোট জমি ২৭০ হেক্টর এর মধ্যে দুই ফসলি জমি ২০০ হেক্টর এখানে টার্গেট ৫০ হেক্টর। ফতেপুর ব্লকের মোট জমি ১৭২ হেক্টর এরমধ্যে দুই ফসলি ৪০ হেক্টর এখানে তিন ফসলি করার টার্গেট ৩০ হেক্টর। অর্থাৎ এই পাইলটিং কার্যক্রমের সর্বমোট টার্গেট ১২০ হেক্টর জমি দুই ফসলি থেকে ৩ ফসলিতে রূপান্তর। এই কর্মসূচি সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন হলে লব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে সম্পূর্ণ উপজেলার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম।
সারাবাংলা/ইউজে/এইচআই