বই বিক্রিতে ছোট-বড় প্রকাশনীর সবাই হতাশ!
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:২৩
আকাশের তারা গোনা বা সাগরের ঢেউ গোনার মতোই অমর একুশে বইমেলার নবম দিন মানুষ গোনার একটা স্বপ্রণোদিত উদ্যোগ নিয়েছিলাম আজ। বিদায়ী মাঘের হিমেল সন্ধ্যায় মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের একেবারে উত্তর কোণে সারাবাংলার স্টলে বসে এই মানুষ গোনার কারণটি হলো— মেলায় আসা কত শতাংশ মানুষ বই কিনে ঘরে ফেরে, সে সম্পর্কে একটা ধারণা নেওয়া।
দেশের একজন প্রথিতযশা শিল্পীকে দিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর কাঠামো ও অঙ্গসজ্জায় সারাবাংলা যে স্টল তৈরি করেছে, বইমেলার বৈকালিক আড্ডার জন্য সেটা তুলনাহীন। কিন্তু, পড়ন্ত বিকেলে আড্ডার উপযোগী কোনো লোক না থাকায় ‘মানুষ’ গুনে ‘পাঠক’ শ্রেণির শতাংশ হার বের করার দারুণ চিন্তা খেলে গেল মথার ভেতরে। অতঃপর উত্তরমুখী বসে মিনিট দশকের মধ্যেই একশ’ মানুষ গোনা শেষ!
এই একশ’ মানুষের মধ্যে পাঠক মিলল তিনজন। অর্থাৎ এই তিন জনের হাতে মিলল কিছু বই। বাকি ৯৭ জনের হাত খালি। অবশ্য একেবারে খালি না। কারও হাতে প্রেমিকার হাত, কারও হাত প্রিয়তমা স্ত্রীর হাতে বন্দি, কারও হাত দখল নিয়েছে প্রিয় সন্তান! কেউবা শূন্য হাতে সন্ধান করছে অনুরূপ শূন্য হাত। কেউ আবার এক হাতে সামলাচ্ছে শাড়ির আঁচল, অন্য হাত ব্যস্ত সেলফি আর ফটো ক্লিকে!
কত কিছুতেই তো এমবার্গ দেওয়া হয়। অমর একুশে বইমেলায় একবার একটু এমবার্গ দেওয়া হোক— সেলফি তোলা যাবে না, ফটো তোলা যাবে না। ন্যূনতম অর্থ খরচ না করে মেলায় ঢোকা যাবে না! এই ‘অবাস্তব চিন্তা’ বাস্তবায়ন করলে হয়তো বইমেলা বিরান মাঠে পরিণত হবে। তরপরও প্রকৃত পাঠকের সংখ্যা বুঝতে একবারের জন্য হলেও এটা করা যেতে পারে। কারণ, উপলক্ষ্য যখন লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে যায়, তখন লাগাম টানা লাগে।
এই যেমন ধরুন, অমর একুশে বইমেলায় এবার প্রথম স্টল পাওয়া কোয়ালিটি পাবলিকেশন্সের বিক্রয়কর্মী তারেক রহমানকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, আজ কয়টা বই বিক্রি করেছেন? তিনি অনেকটা লজ্জাই পেলেন। কিছুই বলতে চাইলেন না।

প্রতিবছরের ন্যায় এবারও দারুণভাবে স্টল সাজিয়েছে পুথিনিলয়। কিন্তু সে অনুযায়ী এখনো পাঠক আসছে না। ছবি: সারাবাংলা
ড. ওয়াহিদুজ্জামানের লেখা ‘রহস্যঘেরা পৃথিবী’, এ এস এম সাইফুল্লাহ’র লেখা ‘পরিবেশ ও রাজনীতি’, ‘বিজ্ঞান কী ও কেন’-এর মতো মননশীল ধারার নতুন বই দিয়ে স্টল সাজালেও বইমেলার নবম দিনে একটি কপিও বিক্রি করতে পারেনি কোয়ালিটি পাবলিকেশন্স।
বই বিক্রি না হওয়ার কারণ সম্পর্কে তারেক রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের প্রকাশনীটা নতুন, স্টলও পড়েছে এক কোণায়। সে কারণে বেচা-বিক্রি নাই। এই কর্নারে আমাদের না দিয়ে বড় কোনো পাবলিকেশন্সকে দিলে পাঠক তাদের খুঁজে বের করে নিত।’
যদি ধরেও নিই ‘কোয়ালিটি পাবলিকেশন্স’ মেলার এক কোণে স্টল পাওয়ায় বই বিক্রি করতে পারছে না, তাহলে একেবারে মাঝখানে স্টল পাওয়া ‘বীকন পাবলিকেশন্স’ কেন খা খা মরুভূমি? বিকেল সাড়ে ৪টায় ২০৩ নম্বর এই স্টলটিতে গিয়ে দেখা যায় বিক্রয়কর্মী আলাউদ্দীন মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছেন। চমৎকারভাবে সাজানো স্টলে একজন পাঠকও নেই। নেই কোনো দর্শনার্থীও!

এভাবেই ফাঁকা পড়ে থাকছে স্টলগুলো। ছবি: সারাবাংলা
বই বিক্রি সম্পর্কে জানতে চাইলে আলাউদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত দুই দিন (শুক্র-শনিবার) কিছু বই বিক্রি হলেও আজ এখন পর্যন্ত কোনো বই বিক্রি হয়নি। এটা শুধু আমরা না, পাশের স্টলগুলোতেও খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ওদেরও বিক্রি কম।’
‘আসলে গত মেলার তুলনায় এবার বই বিক্রি খুবই কম। মানুষ এসে ঘোরাঘুরি করে চলে যায়। তবে, সামনের দিনগুলোতে কিছু বই বিক্রি হতে পারে’— বলেন আলাউদ্দিন।
বইমেলার একেবারে পূর্ব পাশের সারিতে থাকা স্টলগুলো বরাবরই কম বিক্রি হয়— এমনটিই বলে থাকেন প্রকাশক ও স্টলকর্মীরা। তবে এবার শেষ সারির স্টলগুলোর দুই পাশ উন্মুক্ত থাকায় মেলায় আসা ‘খাদ্য শিকারীরা’ এসব স্টলে ঢুঁ মেরে যাচ্ছেন। ফলে কিছুটা হলেও বিক্রি বেড়েছে তাদের। অবশ্য সেটাও আশাব্যঞ্জক নয় বলে জানালেন স্টলকর্মীরা।
সফা প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী দিলা তাহদীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন ৩০/৪০টা করে বই বিক্রি হয়। তবে আজ বিক্রি অনেক কম। এখন পর্যন্ত ৬/৭টা বই বিক্রি হয়েছে। এটা আমাদের জন্য হতাশাব্যঞ্জক।’

বইমেলার ভিড় স্টলে নেই, আছে লেকের ধারে। তাই মেলায় পাঠকের দেখা মিলছে না। ছবি: সারাবাংলা
এসব ছোট এবং নতুন প্রকাশনীর বই বিক্রির অভিজ্ঞতা বরাবরই একই রকম। বই যা বিক্রি হয়, সেটা বড় এবং নাম করা প্রকশনীর স্টল প্যাভিলিয়নেই হয়। সেখানেও এবার হতাশার গল্প ভিড় করেছে। কিছুতেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না প্রকাশনীগুলো।
বিকেল ৫ টার দিকে প্রথমা প্রকাশনীর প্যাভিলিয়ন একেবারে ফাঁকাই মনে হল। পাশে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)-এর প্রকাশনীও পাঠক ও দর্শনার্থী শূন্য। এসব নামকরা প্রকাশনীর ডজন ডজন বিক্রয়কর্মীকে সরিয়ে নিলে প্যাভিলিয়নগুলো শূন্যই পড়ে থাকত।
প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ইউপিএলের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার এ কে এম কামরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কী এক অজানা কারণে যেন এবার বই বিক্রি একেবারেই কম। প্রতিবছর সরকারি দফতরগুলোর জন্য প্রচুর বই কেনা হতো। এবার সেটাও দেখা যাচ্ছে না। আশঙ্কা করছি, বিগত বছরগুলোর মধ্যে এবার সবচেয়ে কম বিক্রি হবে। তবে, এখন যে অবস্থা যাচ্ছে, সামনে এর থেকে ভালো যেতে পারে।’
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম