Tuesday 11 Feb 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাজারে নেই সয়াবিন— সরবরাহ সংকটকে দূষছেন ব্যবসায়ীরা

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:১৪ | আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:২৬

সয়াবিন তেল। ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ভোজ্যতেল বিশেষ করে বোতলের সয়াবিন তেলের মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বলতে গেলে, বাজার থেকে সয়াবিন তেলের বোতল একপ্রকার উধাও হয়ে গেছে। হঠাৎ সয়াবিন তেলের এমন সংকটের নেপথ্য কারণ কী- জানতে চাইলে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা একবাক্যে দূষছেন অপরিশোধিত তেল পরিশোধনকারী শীর্ষ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

বিক্রেতারা বলছেন, চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপ এস আলমসহ আরও দুয়েকটা কারখানা তিন মাস আগে বাজারে তাদের তেল সরবরাহ কমিয়ে দেয়। এখন কার্যত সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় তৈরি হওয়া সংকট কাটাতে অন্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর যেখানে সরবরাহ বাড়ানোর কথা, তারা সেটা করছে না। বরং তারা তেল সরবরাহ আরও কমিয়ে দিয়েছে। আবার পরিবেশকরা কিছু তেল সরবরাহ করলেও এর সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে তাদের কোম্পানির অন্যান্য পণ্য।

বিজ্ঞাপন

ফলে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা দাবি করলেও তেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এর দায় নিতে নারাজ। সরকারি হিসেবমতে, দেশে বছরে ২২ লাখ মেট্রিকটন ভোজ্যতেলের চাহিদা আছে। এর সিংহভাগই আমদানির মাধ্যমে যোগান দিতে হয়। চট্টগ্রাম কাস্টমসের সূত্রমতে, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত অপরিশোধিত তেল আমদানি হয়েছে ৮ লাখ ৬ হাজার মেট্রিকটন। শুধুমাত্র গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এ তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অপরিশোধিত তেল খালাস হয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিকটন। ১ জুলাই থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পামতেল আমদানি হয়েছে ১৪ লাখ ২৩ হাজার মেট্রিকটন।

আমদানি ও খালাসের চিত্র বলছে, এই মুহূর্তে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট হওয়ার কথা নয়। চট্টগ্রামের বাজারে সিটি গ্রুপের তীর ব্র্যান্ড, টি কে গ্রুপের পুষ্টি ব্র্যান্ড, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রূপচাঁদা ব্র্যান্ড এবং মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ব্র্যান্ডের তেলের সরবরাহ বেশি থাকে। এই মুহূর্তে বাজারে স্বল্প পরিমাণে হলেও মিলছে এসব ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল।

বিজ্ঞাপন

বিক্রেতাদের মতে, এস আলম সয়াবিন তেলের চাহিদা ও সরবরাহ একসময় চট্টগ্রামে বেশি ছিল। এ ছাড়া, আরও কিছু অপ্রচলিত ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেলের সরবরাহ ছিল চট্টগ্রামের বাজারে। কিন্তু গত তিনমাস ধরে এসব তেল বাজারে একপ্রকার নেই বললেই চলে।

সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ পাইকারি প্রতিষ্ঠানেই তেল বিক্রি প্রায় বন্ধ। খুচরা বিক্রেতাদের অর্ডার নিলেও তেল বিক্রি করছে না তারা। পাইকারি বিক্রেতাদের হাতে বিভিন্ন কোম্পানির ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) স্লিপের ছড়াছড়ি, কিন্তু বাজারে তেল নেই।

খাতুনগঞ্জের পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী প্রবীর সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিটি, মেঘনা, টিকে- কেউ ঠিকভাবে সাপ্লাই দিচ্ছে না। আমাদের হাতে ডিও রয়ে গেছে, মিলগেটে গেলে তেল না দিয়ে ফেরত দিচ্ছে। এস আলমসহ আরও দুয়েকটা ব্র্যান্ড এখন মার্কেটে নাই। এতে একটা ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে। এ ক্রাইসিসের সুযোগ নিচ্ছে, যারা মার্কেটে আছে তারা। তারা প্রতিদিন তেল সাপ্লাই দিচ্ছে ১০ গাড়ি, ২০ গাড়ি কিংবা সর্বোচ্চ ৩০ গাড়ি করে। আমার দরকার ১০০ গাড়ি, সেখানে ১০ গাড়ি তেল বাজারে এনে আমি কীভাবে সামাল দেব।’

এস আলমসহ আরও দুয়েকটা কারখানার সয়াবিন তেলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাজারে সংকট সৃষ্টির দাবিকে ‘ফাজলামো’ বলে মন্তব্য করেছেন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাজারের ক্রাইসিস তৈরির জন্য কিছু একটা অজুহাত দাঁড় করাতে হবে, সেই অজুহাত হচ্ছে এস আলমসহ আরও দুয়েকটা ব্র্যান্ড। তারা তো গত তিনমাস ধরে তেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে, তাহলে এখন কেন হঠাৎ ক্রাইসিসটা তৈরি হলো? একটা ক্রাইসিস তৈরি করতে পারলে সবার লাভ হয়। রিফাইনার, ডিস্ট্রিবিউটার, হোলসেলার- সবাই মিলে এ ক্রাইসিসটা তৈরি করেছে বলে আমরা মনে করি।’

খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছেন, রূপচাঁদা, তীর, পুষ্টি, ফ্রেশ ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল কেনার জন্য অর্ডার দিলেও তিনদিন পর পর পরিবেশক প্রতিষ্ঠানগুলো সরবরাহ করছে। আবার তেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডের কোম্পানির বিভিন্ন পণ্য কিনতে বাধ্য করছে। ফলে কোম্পানিগুলো সরকার নির্ধারিত দরে তেল বিক্রি করলেও অন্যান্য পণ্য কেনার ব্যয় খুচরা পর্যায়ে তেলের দামের সঙ্গে সমন্বয় করতে হচ্ছে। এতে খুচরা বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে।

নগরীর আসকার দিঘীর পাড়ের মুদি দোকান রাজীব স্টোরের মালিক রিপু নাথ সারাবাংলাকে জানান, এক সপ্তাহ আগে পুষ্টি ব্র্যান্ডের এক কার্টন পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতলের অর্ডার করেছিলেন তিনি। তিনদিন আগে মাত্র দুটি পাঁচ লিটারের বোতল তাকে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে প্রতিটি আধা কেজির দশ প্যাকেট চা-পাতা কিনতে বাধ্য করা হয়েছে তাকে। আজ (সোমবার) একই ব্র্যান্ডের এক লিটারের এক কার্টন সয়াবিন তেল পেয়েছেন। সঙ্গে প্রতিটি এক কেজি করে দশ প্যাকেট চিনিগুঁড়া চাল তাকে কিনতে হয়েছে।

রিপু নাথ বলেন, ‘পুষ্টি তেল পাঁচ লিটার ৮৩৭ টাকা করে কিনেছি। দাম বাড়তি নেয়নি। কিন্তু এর সঙ্গে আমাকে যে চা-পাতা আর চিনিগুঁড়া চাল দিয়েছে, সেগুলো তো আমি বিক্রি করতে পারব না সহজে। কারণ, কাস্টমারের কাছে সেগুলোর চাহিদা নেই। তাহলে আমি যে টাকাটা সেখানে খরচ করেছি, সেটা তো আমাকে তেল বিক্রি করে তুলতে হবে। এজন্য আমাকে বাড়তি দামে তেল বিক্রি করতে হচ্ছে।’

প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে বাজার থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেলের বোতল উধাও হয়ে যাবার পর গত ৯ ডিসেম্বর সর্বশেষ সরকারি পর্যায় থেকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলের সয়াবিন তেলের দাম সর্বোচ্চ ৮ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ১৭৫ টাকা। দুই লিটারের বোতল ৩৮০ টাকা এবং ৫ লিটার ৮৫২ টাকা করা হয়েছিল। খোলা সয়াবিনের খুচরা বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১৫৭ টাকা। এর আগে বোতলের সয়াবিনের দাম ১৬৭ টাকা এবং খোলা তেল ১৪৯ টাকা ছিল। এর পর প্রায় দেড়মাস বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে ফের সংকট শুরু হয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য সিটি গ্রুপের পরিচালক (রেগুলেটরি অ্যান্ড কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহাকে একাধিকবার কল দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে সাম্প্রতিক সংকটের বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে তিনি দাবি করেছেন, সিটি গ্রুপের তীর ব্র্যান্ডের তেল সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। প্রতিদিন কোন ডিলারকে কী পরিমাণ তেল দেওয়া হচ্ছে, সেটা সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরে জানাচ্ছেন তারা। ট্যারিফ কমিশন, ভোক্তা অধিদফতরসহ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থাকেও প্রতিদিনের চিত্র জানানো হয় বলে দাবি বিশ্বজিৎ সাহা’র।

ক্যাবের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা একটা কৃত্রিম সংকট। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আমাদের পরামর্শ হচ্ছে- রিফাইনারিগুলোতে, ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের আড়তে কী পরিমাণ তেল আছে সেটা মনিটরিং করে হিসাব করে বের করা হোক। তাদের কাছে যে পরিমাণ তেল মজুত আছে, সেটা বাজারে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তাদের কাছে অবশ্যই মজুত আছে। কারণ, যে পরিমাণ ক্রুড আমদানি হয়েছে, সেগুলো তো তারা রেখে দেয়ার জন্য আমদানি করেনি। এরপর বসুন্ধরা আর এস আলমের কারখানাগুলো সরকারি হস্তক্ষেপে সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হোক। এতে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

সংকট সয়াবিন তেল সরবরাহ

বিজ্ঞাপন

৬ মাসে ভ্যাট নিবন্ধন বেড়েছে ২৬ শতাংশ
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৮:১৯

আরো

সম্পর্কিত খবর