জুলাইয়ে আহত ১৭৩ ঢাবি শিক্ষার্থীকে সম্মাননা দিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:৩৭ | আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৩:১৪
ঢাকা: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহত দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীদের সম্মাননা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন।
সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বৈষম্যবিরোধী আয়োজিত ‘দ্য হিরোস অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ অনুষ্ঠানে এ সম্মাননা দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তন্বী, সুলতানা, আব্দুল্লাহ সালেহীন অয়ন তাদের অনূভুতি ব্যক্ত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৩ জন শিক্ষার্থীকে সম্মাননা স্বরূপ ক্রেস্ট ও উত্তরীয় দেওয়া হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘দেশে যখন কথা বলার কোনো পরিবেশ ছিল না তখন দেশের তরুণ সমাজ রাজপথে বুক পেতে দিয়েছিল। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেকোনো স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে নেমে এসেছে। এদেশের মানুষ যখন ভেবেছিল কখন তরুণ সমাজ রাজপথে নেমে আসবে, তখন আমরা মাঠে নেমে এসেছি।’
কাদের বলেন, ‘বিগত সময়ের প্রশাসন ফ্যাসিবাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। যখন যে সরকার আসে তখন সেই সরকারের ছাত্রসংগঠন হলগুলো দখল করে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালায়। যেকোনো দুর্বিপাকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য হল বানানো হয়, অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থী নারী; কিন্তু তাদের জন্য মাত্র পাঁচটি হল। আমাদের এত এত ভাই-বোন যে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন, তারা চায় দাসত্বের এই রাজনীতি আর ফিরে না আসুক। প্রশাসন ফ্যাসিবাদের দোসর হয়ে কাজ না করুক। শুধু ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন নয়, হাসিনার বানানো ফ্যাসিস্ট সিস্টেম আমরা ভেঙে দিতে চাই। আগামী দিনে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে আমরা এগিয়ে যাব।’
ঢাবি শিবির সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের মূল স্পিরিট হচ্ছেন আপনারা। আমরা দল মতের ঊর্ধ্বে এসে যতটুকু করা সম্ভব সেটা করেছি। সামনে যদি কখনো কেউ ফ্যাসিবাদী হতে চায়, আমরা সবাই মিলে সেই তার বিরুদ্ধে দাঁড়াব। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেদিকে আগাবে সারা বাংলাদেশ সেদিকে আগাবে।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলের নারী শিক্ষার্থীরা যখন জেগে উঠেছিল তখন খুনি হাসিনার ভিত নড়ে উঠেছিল। আমাদের হল ছাড়া করার পর আমাদের আশা প্রায় ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাই-বোন যখন রাস্তায় নেমেছিল তখন এই আন্দোলন জ্বলে উঠেছিল। এরপর মাদরাসা শিক্ষার্থী, সাধারণ ছাত্র-জনতার বিপুল অংশগ্রহণে আমরা আজকের এই দেশ পেয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানের কোনো রাজনৈতিক দলের কেউ যদি সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থাকে তাহলে তাকেও ডেভিল হান্টের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এতদিন যে সিট সমস্যার কথা বলা হয়েছিল এটা ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে জিইয়ে রাখা একটি সমস্যা। যখনই হলগুলো প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে এলো তখনই এই সমস্যা কেটে গেল। ফ্যাসিজমের ছোট একটি ভার্সন হচ্ছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি আমরা স্টেট কল্পনা করি তাহলে এখানে প্রত্যেকটা মানুষ ব্যক্তি হিসেবে ফ্যাসিস্ট, প্রশাসনিকভাবে ফ্যাসিস্ট, শিক্ষকরা ফ্যাসিস্ট; সেখানে হলের মধ্যে ফ্যাসিজমের চর্চা হয়। আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে ফ্যাসিজমের ঊর্ধ্বে যেতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের নেতার ছেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিদেশে পড়ে। নেতার ছেলেরা বিদেশে পড়ে দেশে এসে নেতা হয়। আর আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা ওই নেতার পিছনে ঘুরে পাছার ছাল তুলে ফেলে। এখানে প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী কোনো দলের না হয়ে নেতা হয়ে উঠুক। ফ্যাসিজমকে আমরা লাল কার্ড দেখিয়ে যাচ্ছি।’
ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, ‘পাকিস্তান পিরিয়ডে যখন উর্দু ভাষা করার কথা বলা হয়েছিল, তখন না বলতে পারার সাহস দেখাতে পেরেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করি। বদলানো যে সম্ভব এটা ’২৪ এর পর আমরা দেখেছি। আমাদের সেই প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে আমরা এখন বাস করি। কোনোধরনের বৈষম্য যাতে ’২৪ এর এই বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্দোলনের আঁতুরঘর বলা হয়। কারণ, এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী একসঙ্গে আন্দোলন করেছে। কিন্তু এবার তা হয়নি। যা আমাদের লজ্জিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হয়েছে হয়েছে, সামনের দিনগুলোতে আমাদের সবাইকে মিলে প্রোপার অবদান রাখতে হবে। আমাদের সম্পদ সীমিত, কিন্তু আন্তরিকতার কোনো সীমাবদ্ধতা নাই। আমাদের ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী সমাজ গঠনে যে ভূমিকা রেখেছে তা ধরে রাখতে হবে।’
ঢাবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়াম হক বিদিশা বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের সদিচ্ছা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি হলগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য। জুলাই স্মৃতি সংগ্রহশালার জন্য আমরা নানা কাজ করছি। এই ঢাবিতে আমরা যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী শিক্ষক রয়েছি, আমরা সবাই মিলে যদি শহিদদের পরিবারকে পাশে নিয়ে জুলাই আন্দোলনের স্পিরিট নিয়ে এগোতে পারি, তাহলে আমরা যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চেয়েছি, তা গড়তে পারব।’
অন্তবর্তী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে এটা অত্যন্ত গৌরবের যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই গৌরবের সাক্ষী হতে পেরেছে। বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, ঢাবি সবসময় পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেয়। এজন্য ফ্যাসিস্ট সরকার চেষ্টা করে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে দমিয়ে রাখতে। স্বৈরাচার জানে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়িয়ে যায় তাহলে এই জাতি দাঁড়িয়ে যাবে। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আত্মমর্যাদা নিয়ে থাকতে পারে তাহলে এই জাতির পরিবর্তন হতে বেশি সময় লাগবে না।’
নাহিদ বলেন, ‘১৫ জুলাই আমরা দেখেছি কিভাবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের ভাই-বোনদের ওপর আক্রমণ করেছে। সেদিন আমরা ঢাকা মেডিকলে আহত শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ দেখেছি। আমরা সেদিন সারাদেশের মানুষের কাছে আহ্বান করেছি আপনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। আমাদের আহ্বান সাড়া দিয়ে সারা দেশের মানুষ এগিয়ে এসেছিল, এটা আমরা আজীবন স্মরণ করব।’
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে নাহিদ বলেন, ‘আমাদের লড়াই এখনো শেষ হয়নি। বিভিন্ন জায়গা থেকে ফ্যাসিবাদের দোসররা আস্ফালনের চেষ্টা করে। আমরা বলে দিতে চাই, জুলাই আগস্ট ভুলে যাবেন না। জুলাইয়ের চেতনা শেষ হয়নি। যদি বিন্দু পরিমাণ আস্ফালনের চেষ্টা করেন তাহলে আমরা দ্বিগুণ শক্তিতে প্রতিহত করব। আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ এই মতাদর্শ বাংলাদেশে আর রাজনীতি করতে পারবে না। আমরা আমাদের এই কমিটমেন্ট রক্ষা করব।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান বলেন, ‘তোমরাই বাংলাদেশ। মানুষকে সম্মান করতে পারার মধ্যে নিজেকে সম্মান করার সুযোগ আসে। তোমাদের কারণে আমরা একটি বিপুল সম্ভাবনার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি। এখানে অনেক চ্যালেঞ্জও আছে। তোমাদের প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়, এই জাতি প্রকৃতপক্ষে ঋণী।’
উপাচার্য বলেন, ‘ডাকসুর জন্য আমরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছি। প্রতিদিন কাজ হচ্ছে। জুলাই স্মৃতিকে ধারণ করাটা একটা সম্মানের বিষয়। জুলাই স্মৃতি সংগ্রহশালার বেশ অগ্রগতি হয়েছে। অবকাঠামোগত কাজ শেষের দিকে। চারুকলার মাধ্যমে কাজ গুছিয়ে রাখা হয়েছে। বেশকিছু গবেষণার কাজ চলছে। গণঅভ্যুত্থানের ওপর এই গবেষণা করা হবে। এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন অধ্যাপক এপ্রিল মাসে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন।’
অধ্যাপক নিয়াজ বলেন, ‘আমরা গত ডাকসু নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করেছি। এছাড়া যতরকমের বৈষম্য হয়েছে তা নিয়ে ফাইল করেছি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অভিযোগ গ্রহণে তিনটি বডি করা হয়েছে, তারা এগুলো সংগ্রহ করছে।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ঢাবির প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ, সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম, মাহিন সরকার, আবু বাকের মজুমদার, ছাত্রফ্রন্টের ঢাবি শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক প্রমুখ।
সারাবাংলা/এআইএন/পিটিএম