প্রজনন মৌসুম
সুন্দরবনে মাছ শিকারের আড়ালে ডিমওয়ালা কাঁকড়া নিধন
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৮:২৮
বাগেরহাট: নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সুন্দরবনে চলছে অবাধে ডিমওয়ালা কাঁকড়া নিধন। মাছ শিকারের আড়ালে শিকারিরা দল বেঁধে মারছে কাঁকড়া। এতে হুমকির মুখে পড়ছে বংশবিস্তার। মরছে বিভিন্ন জলজ প্রাণী, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দুই মাস কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম। এ সময়ে সুন্দরবনে জলজ এ প্রাণীটি শিকার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ও চাহিদা বেশি থাকায় সে নিষেধাজ্ঞা মানছে না শিকারিরা। দিন দিন বড়ছে কাঁকড়া শিকার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিলাসহ ১৪ প্রজাতির কাঁকড়ার প্রজনন হয় সুন্দরবনে। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও দাদনদাররা ডিমওয়ালা বিভিন্ন প্রজাতির মা কাঁকড়া শিকারে জড়িত। তারা বনরক্ষী ও কর্মকর্তাদের ঘুষের মাধ্যমে ম্যানেজ করে ঋণ-দাদনে জর্জরিত জেলেদের দিয়ে কাঁকড়া শিকারে বাধ্য করেন।
প্রজনন মৌসুমে অবাধে ডিমওয়ালা কাঁকড়া শিকারে বংশবিস্তারের পাশাপাশি সুন্দরবনের জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা পরিবেশবাদীদের। তারা বলছেন, প্রজনন মৌসুমে কাঁকড়া রক্ষা করা না গেলে এর বংশবিস্তার মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে পুরো সুন্দরবনের জীববৈচিত্রের ওপর। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক এ সম্পদ রপ্তানিতেও প্রভাব পড়বে।
সুন্দরবনসংলগ্ন বাগেরহাট ও খুলনার কয়েকটি উপজেলার কয়েকজন বনজীবী জেলে জানান, কাঁকড়ার ব্যবসা বেশ লাভজনক। যে কারণে প্রজনন মৌসুমেও কাঁকড়া ধরা বন্ধ হচ্ছে না সুন্দরবনে। অধিক লাভের আশায় একশ্রেণির অসাধু জেলে বন বিভাগের কাছ থেকে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে বনে ঢুকে ডিমওয়ালা কাঁকড়া শিকার করছেন। প্রায় প্রতিদিনই সুন্দরবনের ভেতর থেকে কাঁকড়া ধরে নৌকায় ভরে লোকালয়ে নিয়ে আসা হয়। তারপর তা সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন বাজারে ও আড়তে বিক্রি করা হয়। যাচ্ছে বিদেশেও।
খুলনার পাইকগাছার কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি হীরামন মন্ডল জানান, মূলত খুলনা অঞ্চলের কাঁকড়া চীন, তাইওয়ান, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ড, জার্মানি এবং অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি করা হয়। খুলনা অঞ্চল থেকে প্রায় ২৫টন কাঁকড়া প্রতিদিন ঢাকায় পাঠানো হয়।
এর মধ্যে বাগেরহাট থেকে ৬টন, খুলনা থেকে ৭ টন, সাতক্ষীরা থেকে ৮ টন কাঁকড় পাঠানো হয়। ২০০ গ্রাম ওজনের মাদী কাঁকড়া বিক্রি হয় কেজি প্রতি ২৫০০ টাকায় এবং ১৮০ গ্রাম থেকে ২০০ গ্রামের কম ওজনেরগুলো বিক্রি হয় ২২০০ টাকা দরে। অন্যদিকে ৫০০ গ্রামেরও বেশি ওজনের পুরুষ কাঁকড়া কেজি প্রতি ১৮০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার স্থানীয় কয়েকজন বনজীবী জেলে জানান, সুন্দরবনের নদী-খালে জাল ফেললেই কাঁকড়া ওঠে। এগুলো চড়া দামে বিক্রিও করা যায়। একশ্রেণীর ডিপো মালিক ও আড়তদারা কাঁকড়া শিকারিদের অগ্রিম টাকা দাদন দেন। তারাই সুন্দরবনের প্রভাবশালী কোম্পানি মহাজনদের সহায়তায় অসাধু বনরক্ষী ও কর্মকর্তাদের ঘুষের মাধ্যমে ম্যানেজ করে বনের নদী-খালে কাঁকড়া শিকার করান।
কয়েকজন বনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের জীবন-জীবিকা অনেকটাই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। কাঁকড়া ধরা বেশ সহজ এবং তা তেমন ব্যয়বহুলও নয়। যে কারণে অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার সময় সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার একশ্রেণির জেলে বন বিভাগের কাছ থেকে মাছ ধরার অনুমতি নেন। নিষিদ্ধ সময়েও কাঁকড়া ধরেন।
কাঁকড়া শিকারের পর বনে বসেই তারা বিক্রি করে দেন দ্বিতীয় পক্ষের কাছে। আর দ্বিতীয় পক্ষ নার্সিং পয়েন্ট বা ঘেরের কাঁকড়া বলে স্থানীয় বাজারের বিভিন্ন ডিপোয় বিক্রি করেন। ডিপো ব্যবসায়ীরা কাঁকড়া কিনে ঢাকায় রফতানিকারকদের কাছে পাঠান।
অভিযোগ রয়েছে, কিছু বনরক্ষী ও কর্মকর্তা কাঁকড়া শিকারিদের সহায়তা করেন। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ বা কাঁকড়ার দু-একটি চালান ধরা পড়লেও বন্ধ হচ্ছে না শিকার। আবার যারা ধরা পড়ছেন তথ্যপ্রমাণের অভাবে তারাও সুন্দরবনের প্রভাবশালী কোম্পানি মহাজনদের সহায়তায় দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আবার একই কাজে ফিরছেন।
এ প্রসঙ্গে সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী শুভ্র শচীন বলেন, ‘বেশি দাম ও চাহিদা থাকায় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রচ্ছায়ায় একশ্রেণীর জেলে সুন্দরবনে অবাধে ডিমওয়ালা কাঁকড়া শিকার করেন। এতে কাঁকড়ার বংশবিস্তারের পাশাপাশি সুন্দরবনের জলজ জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিছু অসাধু বনরক্ষী ও কর্মকর্তা কাঁকড়া শিকারিদের সহায়তা করেন। সুন্দরবন সুরক্ষায় এর ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থানে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ এবং বনে প্রবেশাধিকার আরও সংরক্ষিত হওয়া দরকার বলেও মনে করেন তিনি।’
![](https://www.sarabangla.net/wp-content/uploads/2025/02/Crabs-with-eggs-killed-under-the-guise-of-fishing-in-the-Sundarbans-3.jpg)
সুন্দরবন।
শুভ্র শচীন আরও বলেন, ‘সুন্দরবনসংলগ্ন অনেক পরিবারে কাঁকড়া ধরে বিক্রি করেই চলে সংসার। কাঁকড়া ধরার দুই মাসের নিষেধাজ্ঞায় চলতে কষ্ট হয় তাদের। এ সময় তাদের সরকারি সহায়তা খুবই দরকার।’
এ বিষয়ে খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম। এ মৌসুমে সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরা নিষিদ্ধ। সুন্দরবনে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে জেলেসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি বনবিভাগের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে। এরপরও কেউ যদি এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কাঁকড়া আহরণ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চোরাইপথে কাঁকড়া আহরণের প্রবণতা বন্ধে টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
কাঁকড়া শিকারের সঙ্গে বন বিভাগের কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/এসআর
কাঁকড়া নিধন জলজ প্রাণী ডিমওয়ালা কাঁকড়া ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য নিষেধাজ্ঞা অমান্য প্রজনন মৌসুম বাগেরহাট সুন্দরবন