জাতিসংঘের প্রতিবেদন
ধাতব গুলি ব্যবহারে আবু সাঈদকে হত্যা করা হয়
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:২২ | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:৩৬
ঢাকা: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় প্রাণঘাতী ধাতব গুলিতে শহিদ হয়েছেন। তিনি পুলিশের ইচ্ছাকৃত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
জাতিসংঘের তথ্য-অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) কার্যালয় বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) ‘বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট বিক্ষোভের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন’ শীর্ষক একটি তথ্য অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সঠিক ময়নাতদন্ত না হওয়া সত্ত্বেও নথিপত্র অনুযায়ী ক্ষত সম্পর্কিত ভিডিও ফুটেজ এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে যে, আবু সাঈদকে কমপক্ষে দু’টি প্রাণঘাতী ধাতব গুলি ব্যবহারে হত্যা করা হয়েছে। আবু সাঈদ পুলিশের ইচ্ছাকৃত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।’
২৩ বছর বয়সী আবু সাঈদ পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন। সাঈদ তার পরিবারের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি শুরু থেকেই কোটা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে হাজার হাজার স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেটে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী জড়ো হওয়ার ফলে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।
ওএইচসিএইচআর-কে দেওয়া পুলিশের নিজস্ব প্রতিবেদন অনুসারে, বিক্ষোভকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে জোরপূর্বক প্রবেশের চেষ্টা করলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ) সমর্থক ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয় এবং পুলিশ ‘শিক্ষার্থী ও জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ার গ্যাস শেল ও ফাঁকা গুলি বর্ষণ শুরু করে।’
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পুলিশ আবু সাঈদের বিষয়ে আরও বলেছে, তিনি গুরুতর আহত হন এবং পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘মাথায় আঘাত লাগা এবং গুলিবিদ্ধ’ হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য ও ঘটনার ধারাবাহিক শিকার ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও ভিডিওর ভিত্তিতে, ওএইচসিএইচআর-এর এই বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে যে, তার হত্যাকাণ্ডে পুলিশ সরাসরি সম্পৃক্ত ও দায়ী।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্রলীগ সমর্থকদের সহযোগিতায় পুলিশ লাঠি দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আবু সাঈদও মারধরের শিকার হন। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ও শটগান থেকে প্রাণঘাতী ধাতব গুলি ছুঁড়ে। গুলি বর্ষণে বেশ কয়েকজন ছাত্র আহত হয়, যার মধ্যে একজন বিক্ষোভকারী আংশিকভাবে অন্ধ হয়ে যায়।
পুলিশ যখন জনতার ওপর গুলি চালাতে শুরু করে তখন আবু সাঈদ তার হাত ওপরে তুলে ধরেন। ভিডিও ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, এক হাতে বাঁশের খুঁটি ধরে থাকা অবস্থায় তিনি প্রায় ১৪-১৫ মিটার দূরে অবস্থানরত পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য কোনো হুমকি হয়ে দাঁড়াননি।
ওএইচসিএইচআরকে সাক্ষাৎকার দেওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, যখন তিনি পুলিশকে চিৎকার করে বলেন, ‘আমাকে গুলি করো’, তখন দুই পুলিশ অফিসার তাকে প্রাণঘাতি ধাতব গুলি ভর্তি শটগান দিয়ে সরাসরি তার দেহ লক্ষ্য করে একাধিকবার গুলি করে।
ওএইচসিএইচআর ঘটনার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও ছবি পরীক্ষা করেছে এবং সাক্ষ্য প্রমাণের সত্যতা নিশ্চিত করতে ও হত্যাকাণ্ড কীভাবে ঘটেছে তা অনুধাবন করতে ডিজিটাল ফরেনসিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শীর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবু সাঈদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে একজন চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, গুলি আবু সাঈদের ফুসফুসে প্রবেশ করার কারণে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়েছিল। ওএইচসিএইচআর-এর ফরেনসিক চিকিৎসক আবু সাঈদের বিষয়ে প্রাপ্ত মেডিকেল রেকর্ড পরীক্ষা করে দেখেন যে আন্তর্জাতিক ফরেনসিক মান অনুসারে যথাযথ ময়নাতদন্ত করা হয়নি।
চিকিৎসক মৃতদেহের ছবিসহ মেডিকেল প্রমাণ পরীক্ষা করে শটগানের ক্ষত পেয়েছেন। তার বুকের ডানদিকে কমপক্ষে চল্লিশটি ধাতব গুলি এবং বামদিকে পঞ্চাশটি গুলি ছিল। যার মধ্যে হৃদপিণ্ড, ফুসফুস ও পেটের চারপাশের অংশ রয়েছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ফরেনসিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আঘাতের ধরন ও বিস্তার অনুযায়ী আবু সাঈদকে প্রায় ১৪ মিটার দূর থেকে প্রাণঘাতী ধাতব গুলি ভর্তি শটগান দিয়ে কমপক্ষে দুইবার গুলি করা হয়েছিল।’
ভিডিও ফুটেজের ফরেনসিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আবু সাঈদকে গুলি করার ফলে তার ঘাড়, বুক ও বাহু থেকে দৃশ্যমান রক্তপাত হচ্ছিল। তারপরে হাইপোভোলেমিয়া ও মাথা ঘোরার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল।
প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্লেষণে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় আবু সাঈদের মাথা মাটিতে পড়ে আঘাত পাওয়ার মতো মাথায় এমন কোনো গুরুতর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি, যা তার মৃত্যুর বিকল্প কারণ হতে পারে।
সারাবাংলা/পিটিএম