Wednesday 19 Feb 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাওনা টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
বিএনপি নেতাকে মিথ্যা মামলায় হাজত খাটিয়ে এবার ট্রাইব্যুনালে জড়ানোর হুমকি

উজ্জল জিসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:২৯ | আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০০:০৬

দেনাদার জুলফিকার মল্লিক ও ভিকটিম বিএনপি নেতা আবু সাদেক। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: বাকিতে চীনা ‘গিফট আইটেম’ নিতেন। নিতে নিতে কয়েকবছরে প্রায় ৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বাকি হয়ে যায়। সেই টাকা আত্মসাৎ করতেই মিথ্যা মামলা দিয়ে পাওনাদার ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করায়। এর পর ওই ব্যবসায়ী জামিনে বের হওয়ার পর এবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে— এমন অভিযোগ উঠেছে ইংল্যান্ড বিএনপির প্রভাবশালী নেতা পারভেজ মল্লিক ও বাংলাদেশে থাকা তার ছোট ভাই জুলফিকার মল্লিকের বিরুদ্ধে। আর এই অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের লক্ষ্মীপুর জেলার সাবেক সহসভাপতি ও বর্তমান কমিটির উপদেষ্টা আবু সাদেক।

বিজ্ঞাপন

এদিকে ওই ব্যবসায়ী স্বরাষ্ট উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) মহাপরিচালক, পুলিশ মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে অভিযোগ করেছেন। পারভেজ মল্লিকের বিরুদ্ধে তিনি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছেও।

বিজ্ঞাপন

সেই অভিযোগের কপি সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এ ছাড়া, পাওনা টাকা উদ্ধারসংক্রান্ত জিডি ও অভিযোগসংক্রান্ত সব কপি সারাবাংলা ডটনেটের কাছে সংরক্ষিত আছে।

লিখিত অভিযোগে জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের নেতা ও ব্যবসায়ী আবু সাদেক শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সারাবাংলাকে বলেন, “২০১১ সালে প্রতারক চক্ররে অন্যতম মূল হোতা আমার অফিসে এসে অনেক কান্নাকাটি করে বলেন, ‘ভাই আপনি একজন বড় আমদানিকারক। আপনার সামান্য সাহায্য আমার জীবন বদলে দিতে পারে। অনেক আমদানিকারকের কাছে গিয়েছি। কিন্তু কেউ সহযোগিতা করছে না।”

সাদেক বলতে থাকেন, ‘একজন আমদানিকারকের কাছে অর্ডার দিয়ে বর্তমানে টাকার অভাবে ছাড়াতে পারছে না বলে আমাকে জানান প্রতারক জুলফিকার। এমন অবস্থায় সরলমনে তাকে বাকিতে গিফট আইটেম দেওয়া শুরু করি। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম জুলফিকারকে প্রথমে বাকিতে পণ্য দিই। সেই মোতাবেক জুলফিকার নিয়মিত মালামাল নিতে থাকে এবং কোম্পানি থেকে বিল পাওয়ার পর আমাকে পণ্য বিক্রি করে আস্তে আস্তে টাকা দিতে থাকে।’

তিনি বলেন, “ছয়মাস পর আমাকে বলে, ‘ভাই আমার আগের ২৫ লাখ টাকা লোন আছে এবং লোনটা পরিশোধ করতে পারলে আমি আরও অধিক মনোযোগ দিয়ে ব্যবসা বাড়াতে পারব।’ তখন আমি জুলফিকারকে বলি, ‘তুমি লোন পরিশোধ করো। তারপর আমার বাকি টাকা দিও। এভাবে তাকে সব লোন থেকে পুরোপুরি মুক্ত করি। এটা করতে যেয়ে জুলফিকারের কাছে আমার পাওনা টাকার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। চতুর জুলফিকার পণ্য বিক্রি করে আমাকে আস্তে আস্তে টাকা দিতে থাকে এবং নিশ্চয়তার সম্পর্ক তৈরি করে। পরে তাকে বিশ্বাস করে অনেক বেশি মাল আমদানি করে দিই।”

‘ক্রমান্বয়ে আমার কাছে জুলফিকারের আবদারও বাড়তে থাকে। তার বাবা-মাকে হজে পাঠানো, তার বড় ভাই পারভেজ মল্লিককে ইংল্যান্ডে টাকা পাঠানো এবং খুলনায় তার তিন কোটি টাকা দামের বাড়ি নির্মাণ অন্যতম। বিশ্বাস করে জুলফিকারের সব আবদার পূরণ করতে গিয়ে পাওনা টাকার পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। তার পরও ২০২০ সালে করোনার আগ পর্যন্ত ব্যবসায়ে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি।’

ব্যবসায়ী সাদেক বলেন, ‘বিশ্বস্ততার সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, চীন থেকে মাল আমদানি করে কন্টেইনারসহ জুলফিকারের ওয়ারহাউজে পাঠিয়ে দিই। পণ্য বিক্রি করার পর জুলফিকার যে হিসাব পাঠায় সেটাই বিশ্বাস করি আমি। হঠাৎ করোনাকালীন চীনে আসা-যাওয়া বন্ধ এবং পাঁচটি কন্টেইনার নিলামে ওঠার কারণে ব্যবসায়িকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হই। আমদানি আগের তুলনায় গাণিতিক হারে কমতে থাকে। কিন্তু জুলফিকারের কাছে আমার টাকাগুলো পাওনা পড়ে থাকে।’

‘২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জুলফিকারকে ই-মেইলে বকেয়া বিলের হিসাব পাঠাই। আর তাকে গোডাউনে আমার যে মাল ছিল সেটার হিসাব পাঠাতে বলি। সে অনেকদিন পর গোডাউনের মাল বিক্রি শেষ করে আমাকে হিসাব দেয়। ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তার কাছে পাওনা ছিল ৩ কোটি ২২ লাখ ৮ হাজার ১৬২ টাকা। আর গোডাউনের মাল বিক্রি বাবদ ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩ কোটি ৪১ লাখ ৫৪ হাজার ৭৯৪ টাকাসহ সর্বমোট পাওনা দাঁড়ায় ৬ কোটি ৬৩ লাখ ৬২ হাজার ৯৫৬ টাকা।’

দেনাদার জুলফিকার মল্লিকের ভাই ইংল্যান্ড বিএনপির নেতা পারভেজ মল্লিক। ছবি: সংগৃহীত

দেনাদার জুলফিকার মল্লিকের ভাই ইংল্যান্ড বিএনপির নেতা পারভেজ মল্লিক। ছবি: সংগৃহীত

তিনি বলেন, “এর মধ্যে জুলফিকার ৩ কোটি ৭১ লাখ টাকার সাতটি চেক দেয় আমাকে। বাকি টাকাও পর্যায়ক্রমে দেওয়ার আশ্বাস দেন। চেক দেওয়ার সময় জুলফিকার আমাকে বলেন, ‘ভাই আমি আস্তে আস্তে টাকা দেব। তাই একাধিক চেক দিলাম তারিখ ছাড়া। আমি বলে দেব, কোন তারিখে, কোন চেক জমা দেবেন। বাকি টাকাও দিয়ে দেব, আপনি কোন চিন্তা করবেন না’। কিন্তু এরপর থেকে প্রতারক জুলফিকার আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এমনকি ফোন করলে ধরে না। লোক পাঠানোর পরও কোনো রেসপন্স করে না। এমনকি আমি নিজে সরাসরি তার অফিসে গেলেও সে দেখা করেনি। সে টাকা না নিয়ে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। পরে উপায়ান্ত না দেখে ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শের-ই-বাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করি [জিডি নং ৮১১]।”

আবু সাদেক বলেন, “জিডির পর ডিবি ছায়া তদন্ত শুরু করে। তখন প্রতারক জুলফিকার এক পত্রিকার সম্পাদকের মাধ্যমে আমাকে সমঝোতার প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী ঢাকা ক্লাবে জুলফিকার এবং সেই প্রভাবশালী সম্পাদক ও তারই পত্রিকার অনলাইন ইনচার্জের উপস্থিতিতে সমঝোতা বৈঠক হয়। বৈঠকে আমার পাওনা ৬ কোটি ৬৩ লাখ ৬২ হাজার ৯৫৬ টাকা পরিশোধের দাবি তুলি। জুলফিকার তখন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করে। যার মধ্যে ১০ বছরের অফিস ভাড়া ও ১০ বছরের ব্যাংকের সুদও দাবি করেন। সেটাও কমানোর পর ওই সম্পাদক আমাকে অনুরোধ করে বলেন, ‘আপনি বড় ব্যবসায়ী, আপনি ত্যাগ স্বীকার করেন। জুলফিকারের ব্যবসার অবস্থা ভালো না। তাই আপনাকে যে চেক দিয়েছে, অর্থাৎ ৩ কোটি ৭১ লাখ টাকার বেশি দিতে পারবে না। আপনি যেভাবেই হোক এটা মেনে নেন’।”

পাওনা টাকা আদায়ে আইনগত প্রতিকার চাওয়া নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি ওই সম্পাদকের অনুরোধে সেটাও মেনে নিই। কিন্তু তার পর থেকে আজ পর্যন্ত জুলফিকার আমাকে একটি টাকাও দেয়নি। টাকা না দেওয়ার হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে কাল্পনিক কিছু অভিযোগ এনে আমাকে ডিবি হারুনের সহযোগী হিসেবে উপস্থাপনের নাটক মঞ্চস্থ করে। বাস্তবে ডিবি হারুনের সঙ্গে আমার জীবনে কোনোদিন দেখাও হয়নি। প্রতারক জুলফিকার আমাকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ আমি ২০২০ সাল পর্যন্ত লক্ষ্মীপুর জেলা জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের সহ-সভাপতি ছিলাম। বর্তমান কমিটিতেও আমি উপদেষ্টা পদে আছি।’

সাদেকের দাবি, তার পরিবারের কেউ বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ কিংবা তার কোনো সহযোগী সংগঠনের সমর্থনও করেনি। বরং, বিগত দিনে তিনি নিজেও ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তার ও তার পরিবারের সদস্যদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল। কিন্তু পাওনা টাকা মেরে দিতে তাকে পতিত স্বৈরাচারের দোসর বানানোর অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জুলফিকার ও তার ভাই পারভেজ।

সাদেক অভিযোগ করে বলেন, ‘৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও নেতাদের নাম ভাঙিয়ে জুলফিকার ও তার লন্ডন প্রবাসী বড়ভাইসহ কয়েকজন আমাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি ও হেয় করার অপচেষ্টায় কাল্পনিক অভিযোগ করে। শুধু এখানেই শেষ নয়, প্রতারক জুলফিকার পাওনা টাকা পরিশোধ না করে উল্টো আমার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধী ডিবি হারুনের প্রধান সহযোগী বানিয়ে চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা দেয়। এর সেই মামলায় আমাকে গ্রেফতার করিয়ে জেল-হাজতে পাঠায়।’

তিনি বলেন, ‘আমি জুলফিকারের দায়ের করা মিথ্যা মামলায় বিজ্ঞ আদালতের জামিন পেয়ে বের হয়েছি। এর পর থেকে প্রতারকচক্র বিভিন্ন মামলায় আমাকে ফাঁসানো, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের মামলায় জড়ানো এবং নতুন আরও মামলার হুমকি দিচ্ছে।’

এ বিষয়ে জানতে জুলফিকারকে শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে মোবাইল ফোনে কল করা হয়। তবে তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সারাবাংলাকে বলেন, ‘তার পাওনা টাকা আমি ২০১৯ সালে তার অ্যাকাউন্টে দিয়েছি। এরপর চেক ফেরত চেয়েও পাইনি।’ আপনি চেক উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেননি কেন? জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি। উল্টো জুলফিকার সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা সাদেকের কাছে পান বলেও অভিযোগ করেন। কে কার কাছে টাকা পাবে তা আদালত নির্ধারণ করবে বলেও জানান জুলফিকার।

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম

ট্রাইব্যুনাল দেনাদার পাওনাদার বিএনপি নেতা মিথ্যা মামলা হাজত হুমকি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর