Friday 21 Feb 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভাড়া বাড়ছেই
সব সংস্কারে হাত দিলেও বাড়িভাড়া নীতিমালা নিয়ে নেই উদ্যোগ

মেহেদী হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:০৫

দিন দিন রাজধানীতে বেড়েই চলেছে বাড়িভাড়া। ছবি: সারাবাংলা

ঢাকা: রাজধানী ঢাকায় যাদের বাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে তারা বলতে গেলে নিশ্চিন্তে জীবন-যাপন করতে পারেন। যাদের দু’টির একটিও নেই মাস শেষে তাদের ভাড়া পরিশোধের একটা উৎকণ্ঠা লেগেই থাকে। বলতে গেলে মাসের মূল খরচের অর্ধেক-ই চলে যায় বাসা ভাড়ায়। এর মধ্যে বছর শেষে যোগ হয় আরেক উৎকণ্ঠা। সেটা হলো- বিনা বিবেচনায় ও নোটিশ না দিয়েই হুটহাট ভাড়া বৃদ্ধি। পরিস্থিতি এমন রূপ ধারণ করেছে যে, প্রতিটি বাড়ি যেন একেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু বাড়িগুলোকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেনে নিলেও সেবার মান কিন্তু বাড়ছে না। মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে প্রতিবছরই এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন বাড়িওয়ালারা। এক্ষেত্রে তারা বাড়িভাড়ার নীতিমালাকেও মানছে না। আবার নীতিমালার কথা বলা হলে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন ধারিয়েছে যে, খরচের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে মধ্যবিত্ত সাধারণ পরিবারগুলো তাদের বউ-ছেলে-মেয়েকে গ্রামে বা নিজ জেলায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। আবার কোনো কোনো পরিবার মাসের খাবারের জোগান কাটছাট করছে।

বিজ্ঞাপন

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৭৫ শতাংশ ব্যয় করেন বাড়িভাড়া পরিশোধে।

বেপরোয়া বাড়িওয়ালাদের অত্যাচারে রাজধানী ঢাকায় বসবাস করতে নাভিশ্বাস উঠেছে কর্মজীবী ভাড়াটিয়াদের। করোনাকালে গুটিকয়েক বাড়িওয়ালা মানবিকতা দেখালেও বেশিরভাগই ছিলেন ভাড়া না কমানোর নীতিতে অটল। এদিকে প্রতিবছর বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হচ্ছে সার্ভিস চার্জ। আর এভাবেই ভাড়াটিয়াদের সর্বশ্বান্ত করে দিচ্ছে বাড়িওয়ালারা।

ধারণা করা হয়েছিল ২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার অন্যান্য সংস্কারের পাশাপাশি বাড়িভাড়া নীতিমালাতেও হাত দেবেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি। সবকিছু সংস্কার নিয়ে কথা বললেও বাড়িভাড়া সংস্কার নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না। ফলে ফ্যাসিবাদ সরকারের পতনের পর নতুন বাংলাদেশে বাড়িওয়ালাদের কে রুখবে?- এমনই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ ভাড়াটিয়াদের মনে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিবছরই বাড়ছে বাড়ি ভাড়া। রাজধানীর যেসব এলাকা একটু অভিজাত হয়ে উঠছে সেখানার বেশিরভাগ ফ্ল্যাটের খরচসহ ভাড়া পড়ছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। এ ছাড়া, মানভেদে প্রতিবছর ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। সেইসঙ্গে সার্ভিস চার্জের নামে ভাড়াটিয়াদের গুনতে হচ্ছে আলাদা টাকা। এই প্রভাব পড়েছে রাজধানীর বাইরের নগরী চট্টগ্রামেও। অথচ, চাকরিজীবীদের বেতন প্রতিবছর বাড়ছে না। আর যাদের বাড়ছে, সেটাও খুব সামান্য।

বাড়তি ভাড়াসহ নানান অভিযোগের বিষয়ে বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, প্রতিনিয়ত বাড়ির ট্যাক্স বাড়ানো হচ্ছে, যা অতিরিক্ত। বাড়ির নিরাপত্তার জন্য আলাদা লোক দরকার হয়। তাদের বেতন ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে নিয়েই দিতে হয়। এ ছাড়া, অন্যান্য খরচ তো আছেই।

রাজধানীর মিরপুর ১২ নম্বরে বসবাস করেন সোলায়মান শাওন। তিনি একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আমি এখন যে বাসায় থাকি সেটির ভাড়া গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ১৮ হাজার টাকা। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দুই হাজার টাকা বাড়িয়েছে। আর এই বাড়তি টাকা না দিলে বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলেছে বাড়িওয়ালা। এর সঙ্গে প্রতিমাসে সার্ভিস চার্জ হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আমার মাসিক বেতন ২৫ হাজার টাকা। তাই আরেকজনের সঙ্গে শেয়ার করে থাকতে হচ্ছে।’

রাজধানীর ওয়ারীতে নতুন বসবাস শুরু করেছেন জুলিয়া জেরিন। তিনি স্বামী সন্তান নিয়ে খুলনায় থাকতেন। সারাবাংলাকে তিনি জানান, তার স্বামী একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তার বদলির সুবাদে দুই মাস ধরে তিনি ঢাকায় এসেছেন। কিন্তু ২৫ হাজারের নিচে কোথাও বাড়িভাড়া পাচ্ছিলেন না। এখন স্বামীর স্বল্প বেতনে রাজধানীতে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

বেসরকারি চাকরিজীবী শাহের আলী। থাকেন রাজধানীর মিরপুরের বর্ধিত পল্লবীতে। সারাবাংলাকে তিনি জানান, তিন রুমের ফ্লাটে পরিবার নিয়ে থাকেন। ভাড়া ২৫ হাজার, সার্ভিস চার্জ ছয় হাজার। একার পক্ষে প্রতি মাসে এই খরচ বহন করা তার জন্য খুবই কষ্টকর। তাই নতুন বাংলাদেশে বাড়িওয়ালাদের এই স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড থেকে মুক্তি চান তিনি।

গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশে বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বিষয়ে সংস্কার নিয়ে স্থপতি ইকবাল ইকবাল হাবীব সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাষ্ট্র ক্ষমতায় কে যাবে, কীভাবে যাবে এবং এর সঙ্গে অল্প কয়েকটি মিশনারি ইক্যুইপমেন্টের বিষয়গুলো দেখছি সংস্কার প্রস্তাবে। কিন্তু পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখিনি।’

তিনি বলেন, ‘বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার বিষয়গুলো সরাসরি তাদের ওপর ডিপেন্ড করে না। এখানে আরও অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে। সেই ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এলাকাভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা। অথচ এগুলো করা হয় জনগণের টাকায়। কিন্তু সেই জনগণকেই আবার বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে।’ তিনি মনে করেন, অঞ্চলভিত্তিক সবধরনের মানুষের বসবাসের একটা বন্দোবস্ত থাকতে হবে।

ইকবাল হাবীব বলেন, ‘যেহেতু সরকার উদ্যোগ নেয়নি, উচিত ছিল এ বিষয়ে অবশ্যই বাড়ির ভাড়ার এলাকাভিত্তিক একটা অ্যাভারেজ তৈরি করা। এই কাজটা করা হয়নি। এই মুহূর্তে প্রায়োরিটি দেওয়ায় হচ্ছে ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ায়। ফলে আমরা পরিবেশ সংস্কারের একটা সুযোগ হারালাম। এমনকি সকলের মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের যে মৌলিক অধিকার সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এবারও পাওয়া গেল না। ফলে জনগণের বঞ্চনার তালিকাটা দীর্ঘ হলো।’

বাংলাদেশের এই স্থপতি বলেন, ‘এই সরকারই সবকিছু সংস্কার করবে এটা আমি আশা করি না। তারা যদি সংস্কারের প্রস্তাবটা করে রেখে যেত, যা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে চাপে দিতে পারত- সেই প্রত্যাশাটা করি। ঢাকা শহরে বিশেষ করে করোনার পরে বাড়িভাড়ার জন্য প্রবল চাপ তৈরি হয়েছে মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য। এ বিষয়ে পলিসিগত সংস্কারের সিদ্ধান্তটা নিয়ে রাখা যেতে পারে, এখনো সময় আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কী কী শর্তে এলাকাভিত্তিক ভাড়া বাড়ানো যাবে এবং কর কী করকম হতে পারে- সেটার একটা গাইডলাইন থাকা প্রয়োজন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের জন্য এটা করা সহজ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এটা করা কঠিন। কারণ, তারাও নির্বাচনের চাপে আছে। তাই পলিসিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপারটা আলোচনায় রাখলে হয়তো ভুক্তভোগী বা বঞ্চিত মানুষের জন্য উপকার হতো।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগে সরকার আগে থেকেই ব্যর্থ। আর এ বিষয়ে বর্তমান সরকারের কোনো উদ্যোগই চোখে পড়ছে না। বাড়ি ভাড়ার বিষয়ে তারা যদি একটা সংস্থা তৈরি করে এবং সেখানে যদি ভাড়াটিয়ারা ভাড়া দেয় তাহলে এটি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। পাশাপাশি সরকারও একটা রাজস্ব পাবে।’

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৩০৬ বর্গকিলোমিটারের এই ঢাকায় বর্তমান জনসংখ্যা দুই কোটিরও বেশি। আর গত ১০ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। ১৯৯১ সালে ভাড়া নিয়ন্ত্রণে ‘বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করা হলেও প্রায় তিন যুগেও গঠিত হয়নি স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

সারাবাংলা/এমএইচ/পিটিএম

উদ্যোগ বাড়িভাড়া নীতিমালা সরকার সংস্কার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর