সিন্ডিকেট চক্রের চাঁদাবাজি
শেখ হাসিনাসহ ১৮৯ জনের নামে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার
২ মার্চ ২০২৫ ১০:০০ | আপডেট: ২ মার্চ ২০২৫ ১৪:৪০
ঢাকা: জুলাই আন্দোলন চলাকালে গণহত্যার ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৮৯ জনের নামে আদালতে একটি মামলার আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই আবেদনটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে বাদী। একটি হত্যা মামলা তড়িঘড়ি করে কীভাবে প্রত্যাহার হলো তা নিয়ে রীতিমতো চমকে ওঠার মতো তথ্য মিলেছে।
অভিযোগ উঠেছে, একটি সিন্ডিকেট আদালতে মামলার আবেদনের পর একাধিক আসামির কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা খেয়ে মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কিন্তু হত্যা মামলা বাদী প্রত্যাহার করতে চাইলেই কী সম্ভব?- এমন প্রশ্ন নিয়ে যখন চলছে বিশ্লেষণ তখন বের হয়ে এলো এর পেছনের সিন্ডিকেট চক্রের কথা।
আদালতে মামলার আবেদন করা হলে প্রথমে বিচারক থানাকে হয় তদন্তের নির্দেশ দেন, অথবা গ্রহণের নির্দেশ দেন। যদি কোনো মামলায় তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন প্রতিবেদন জমার জন্য সময়ও দেওয়া হয়। ওই সময় কিন্তু মামলা রুজু হয় না। আর এই সুযোগে সিন্ডিকেট বিভিন্ন আসামিকে ফোন করে টাকার বিনিময়ে মামলা প্রত্যাহারের অফার দেন। কেউ টাকা দিতে রাজি না হলে তাকে আরও মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হয়। আবার কেউ মোটা অংকের টাকা দিলে বাদী আদালতে গিয়ে মামলা না চালানোর জন্য বিচারক বরাবর আবেদন করেন। যেহেতু মামলা রুজু হয় নাই, সেহেতু আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত আবেদন মঞ্জুর করতে পারেন।
জানা যায়, গত ৮ জানুয়ারি ঢাকার সিএমএম আদালত থেকে উত্তরা পূর্ব থানার মামলাটি (সিআর মামলা নম্বর ৪৪/২০২৪) প্রত্যাহার করা হয়। ধারা ছিল ১০৯/১১৪/৩০২/৩৪ দণ্ডবিধি। মামলার বাদী ছিলেন মফিজুল সানা। তার পিতার নাম মমিন সানা। তার বাড়ি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার বাতিখালীর উত্তর ওয়াবদা গ্রামে।
বাদী মফিজুল সানা গত বছরের ৮ডিসেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলার আবেদন করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে উত্তরা পূর্ব থানাকে তদন্ত করতে নির্দেশ দেয়। মামলাটি এক মাসের মাথায় অর্থাৎ ৮ জানুয়ারি প্রত্যাহার করা হয়। এই মামলাটি কেনইবা করা হলো, আর কেনইবা প্রত্যাহার করা হলো তা ভিকটিমের পরিবার জানে না।
মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি, দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে, তিন নম্বর আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। চার ও পাঁচ নম্বর আসামি হলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও তথ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত। বাকি ১৮৪ জন ঢাকা ও ঢাকার বাইরের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, জাতীয় পার্টি নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন মেয়র ও কাউন্সিলর।
মামলা করার পর গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর বাদী আদালতকে বলেন, ‘আমি এই মামলার নালিশকারী। এখন এই মামলা পরিচালনা করতে ইচ্ছুক নই। তাই আমি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করছি।’ এর পর গত ৮ জানুয়ারি ঢাকা মেট্টোপলিটন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মো. রাগীব নুর মামলা প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করেন।
ডিএমপির নিউ মার্কেট থানার সাবেক এক অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিআর মামলা থানায় রুজু হয়ে গেলে সেই মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। কারণ, সিআরপিসির ধারা হচ্ছে, ৩০২ ধারায় ঘটনা ঘটলে এবং মামলা হলে তা মীমাংসা যোগ্য নয়। তবে সিআর মামলা থানায় রুজু না হলে সেটি বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের বিচারক প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করতে পারেন।’
জুলাই আন্দোলনের পর সারাদেশে প্রতিটি থানায় গণহত্যা নিয়ে একাধিক মামলা হতে থাকে। এ সময় একটি সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করার অভিযোগ ওঠে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মামলা দেওয়ার পর চক্রের কোনো এক সদস্য আসামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মোটা অংকের টাকা দাবি করতো। টাকা দিলে মামলা তুলে নেওয়া হবে; আর না দিলে অন্যান্য থানায় আরও একাধিক মামলা দেওয়া হবে বলেও হুমকির অভিযোগ ওঠে।
মামলা বাণিজ্য নিয়ে গণমাধ্যমে একের পর সংবাদ প্রকাশিত হলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টাসহ অনেকেই কথা বলেন। বলা হয়, কোনো মামলা তদন্ত না করে কাউকে গ্রেফতার করা হবে না। তদন্তে কোনো ধরণের সত্যতা পাওয়া না গেলে কাউকে হয়রানিও করা হবে না।
সে সময় মামলা বাণিজ্য নিয়ে আইজিপি বাহারুল আলম হুঁশিয়ারি করে বলেছিলেন, ‘মামলা বাণিজ্যের সঙ্গে যারা জড়িত থাকবে তাদের কঠোর হাতে দমন করা হবে।’ এর পর ডিএমপি কমিশনার বলেছিলেন, ‘ঢাকা মহানগরীতে কোনো থানায় কোনো একটি মামলা বাণিজ্যের সঙ্গে পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন থানায় এ ধরণের মিথ্যা মামলা করেই চলেছে একটি চক্র। যেমন গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় গত বছরের ১৯ জুলাইয়ে ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। ১৯ জুলাই গুলিতে শহিদ হন মুফতি শিহাব উদ্দিন। তার পরিবার মামলা না করলেও মামলাবাজ এক সিন্ডিকেট ১৯ ফেব্রুয়ারি মামলাটি করেন। মামলা করেই এজাহারে থাকা ৬৪ নম্বর আসামি তৌহিদুল ইসলামকে ফোন করে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন চক্রের এক সদস্য।
১৯ ফেব্রুয়ারির ওই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আসামি সংখ্যা ১০০ জনকে করা হয়েছে। তৌহিদুল ইসলামের নাম কী কারণে মামলায় এসেছে সে বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়নি। কারণ, তৌহিদুল ইসলাম একজন লন্ডন প্রবাসী এবং তিনি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন না।
পরে ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে একটি সংবাদ সম্মেলন করে মামলা বাণিজ্যের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম