অপতৎপরতা ঠেকাতে তৈরি ছাত্রলীগ-যুবলীগের তালিকা
৯ মার্চ ২০২৫ ২২:৩৯
ঢাকা: দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ, খুন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ অরাজকতা ও অপতৎপরতা ঠেকাতে ঢাকাসহ সারাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের তালিকা তৈরি করেছে পুলিশ। তালিকা অনুযায়ী নজরদারিসহ গ্রেফতার কার্যক্রম পরিচালনা করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
যদিও বেশ কিছুদিন ধরে চলমান রয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। এতেও ছিনতাই, ডাকাতি, খুন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা বেড়েছে। এজন্য ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের তালিকা তৈরির কাজ করছে পুলিশ। এখন সুনির্দিষ্ট অভিযান শুরু করলে এ ধরণের অপরাধ থাকবে না বলে অভিমত দিয়েছে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সোমবার (৯ মার্চ) পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা, ডিএমপির বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বেশ কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার ও বিভিন্ন থানার ওসিদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলে তালিকা তৈরির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত, ৫ আগস্টের পর ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ এনে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এর পর থেকে ছাত্রলীগ সারাদেশে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পায়।
সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটের পাঁচটি থানার মধ্যে দু’টি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সক্রিয় নেতা-কর্মীদের নামে তালিকা করা হয়েছে। প্রতিটি থানায় অন্তত ৫০ জন নেতা পর্যায়ের তালিকা রয়েছে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু সক্রিয় কর্মীর তালিকাও রয়েছে।’ এরই মধ্যে যাদের নামে মামলা হয়েছে তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান ওসি।
তালিকা তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন লালমনিরহাট ছাত্রলীগের সাবেক একজন নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘তালিকা তৈরি করেছে ডিএসবি। থানাগুলোতে সেই নামের তালিকা রয়েছে। বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীরা তালিকা তৈরিতে সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। সেই তালিকা ধরে টাকা-পয়সা চাওয়া হচ্ছে।’ টাকা দিলে তালিকা থেকে নাম প্রত্যাহার করা হবে বলেও তাদের জানানো হয়েছে।
পুলিশ সরাসরি টাকা চেয়েছে কিনা? জানতে চাইলে ওই নেতা বলেন, ‘না পুলিশ সরাসরি চায়নি। তবে যারা চেয়েছেন তারা জানিয়েছে, থানা পুলিশকে টাকা দিতে হবে।’
রংপুর রেঞ্জের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশক্রমে অপরাধীদের তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। পাশাপাশি ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ করে যারা জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, গুলিবর্ষণ করেছিল অথবা পতিত সরকারকে নানাভাবে সহায়তা করেছিল তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।’
সিরাজগঞ্জ সদর থানার এসআই মনিরুল ইসলাম অপু সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিরাজগঞ্জ সদর থেকে ছাত্রলীগের ২০০ নেতাকর্মীর তালিকা করা হয়েছে। এছাড়া ১০০ জনের মতো যুবলীগ সদস্যের নামে তালিকা রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে গ্রেফতার হয়েছে, আবার অনেকে পলাতক। পলাতকদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের তালিকা তৈরির বিষয়টি সত্য। তবে সঠিক কতজনের তালিকা পাঠানো হয়েছে তা বলতে পারছি না। ওই তালিকা অনুযায়ী গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছ।’
যশোর জেলা পুলিশ কার্যালয়ের এক পরিদর্শক সারাবাংলাকে বলেন, ‘লাগাতার খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানারকম অপরাধমূলক কাজ শুরু হয়েছে। হঠাৎ করে এসব অপরাধ বেড়ে গেছে। সাবেক সরকারের অনুগতরা এসব কর্মে লিপ্ত আছে- এমন তথ্য পেয়েই মূলত তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। তালিকাটি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে পাঠানো হয়েছে।’
ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের নামের তালিকা তৈরির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেট জেলা পুলিশও। তাদের দাবি, এই তালিকা তৈরির ফলে সমাজে অনেকটা অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে। অনেকে আতঙ্কিত হয়ে অপরাধ করার সাহস পাবে না। তালিকায় থাকাদের অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে। তাদের ধরতে আমরা অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা পুলিশের এক পরিদর্শক।
এ বিষয়ে জানতে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ বা যুবলীগ বলে কোনো কথা নয়। পুলিশ অপরাধীদের তালিকা তৈরি করেছে। এটি সবসময়ই করে থাকে। সবসময়ই তালিকা হালনাগাদ করা হয়। কারণ, তালিকা না থাকলে তো অভিযান চালানো যাবে না। কাজেই এ ধরণের তালিকা পুলিশের কাছে সবসময়ই থাকে।’
ডিএমপির মাঠ পর্যায়ের পুলিশ পরিদর্শক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘মহানগরে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবকলীগের নেতা কর্মীদের নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেই তালিকা অনুযায়ী অভিযান চালানো হচ্ছে। এই তালিকা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও তৈরি করেছে।’
জানতে চাইলে ঢাকা সিটি এসবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘হঠাৎ করে খুন, ধর্ষণ, চুরি ছিনতাই ডাকাতি বেড়েছে। এর পেছনে মূলত কলকাঠি নাড়ছে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা। তারা কেউ নিজেরাই অপকর্মে থাকছে, আবার অনেক জায়গায় টোকাই লেলিয়ে দিচ্ছে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের পর নেতাকর্মীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকা তৈরির ফলে এলাকাভিত্তিক কে কোন এলাকায় রয়েছে তা সহজেই জানা যাচ্ছে। কোন এলাকায় কী ধরণের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তাও শনাক্ত করা সহজ হবে।’
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর সারাবাংলাকে বলেন, ‘সারাদেশে একটি তালিকা তৈরি হয়েছে, যা পুলিশের রুটিন মাফিক কাজ। অপরাধের ধরণ বুঝে নতুন করে তালিকা করা হয়েছে। আগের সরকারের তালিকা ধরে নতুন সরকার বা পুলিশের নতুন সেটাপ কাজ করবে না। সবকিছু নতুন হলে তালিকাটাও হালনাগাদ থাকাটা জরুরি। আর সেটাই করা হয়েছে। স্পেসিফিক কোনো দলের নেতাকর্মীদের আনা হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে সেই দলের যদি কেউ অপরাধী হয়ে থাকে তাহলে তাকেও অপরাধী হিসেবে আনা হয়েছে।’
অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম