স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে চিঠি
রমেকে’র সেই চিকিৎসকের শাস্তি চান তারই সহকর্মীরা
১১ মার্চ ২০২৫ ২০:৩২ | আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৫ ২০:৪০
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমান। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা
রংপুর: অপচিকিৎসায় দুই রোগীর মুত্যুসহ রক্তনালীর রিং বাণিজ্যের ছয়টি লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমানকে বদলি করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানিয়েছে তারই বিভাগের বিভাগীয় প্রধানসহ চিকিৎসকরা।
মঙ্গলবার (১১ মার্চ) কার্ডিওলজি বিভাগের সকল চিকিৎসক একযোগে হাসপাতালের পরিচালকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে কার্ডিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, রেজিস্ট্রার ও সহকারী রেজিস্ট্রারসহ ১১ জন চিকিৎসক সহকর্মী ডা. মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ তাকে অন্যত্র পদায়ন বা বদলির আবেদন জানিয়ে চিঠি দেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে অভিযোগ করা চিকিৎসকরা হলেন— সহযোগী অধ্যাপক ডা. হরিপদ সরকার, সহযোগী অধ্যাপক ডা. রবীন্দ্র নাথ বর্মন, সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাহিদ, সহকারী অধ্যাপক ডা. হাসানুল ইসলাম, জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মো. আশেকুর রহমান, এবং সহকারী ডা. মো. আব্দুল আলীম সরকারসহ ১১ জন চিকিৎসক।
তারা ওই চিঠিটি বলেন, “অত্র বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহবুবুর রহমান কর্তৃক হার্টের রক্তনালীতে রিং পরানোর অনিয়ম নিয়ে ভুক্তভোগী রোগী ও তাদের স্বজনরা স্বাস্থ্য অধিদফতর ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লিখিত অভিযোগ করেছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি তদন্ত কমিটি (একটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক অপরটি হাসপাতালের পরিচালক কর্তৃক গঠিত) কর্তৃক তদন্তও হয়েছে। কিন্তু, এরই মধ্যে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সূত্রে আমরা জেনেছি যে, ডা. মো. মাহবুবুর রহমান অভিযোগকারীদের নানা রকম ভয়ভীতি ও অর্থনৈতিক প্রলোভন দেখিয়ে উত্থাপিত অভিযোগগুলো প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগ করে আসছেন।”
ওই চিঠিতেও কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসকরা বলেন, “ডা. মো. মাহবুবুর রহমান হাসপাতালের ক্যাথল্যাবের নীতিমালা লঙ্ঘন করে অনিয়ম করেছেন, ডাক্তার হিসেবে রিং (Stent) বিক্রির নিয়ম না থাকলেও তিনি নিজেই রোগীদের কাছে উচ্চমূল্যে রিং বিক্রি করেছেন। বিষয়টিতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে কর্মরত আমরা সকলেই অত্যন্ত বিব্রত এবং প্রতিনিয়ত রোগীদের এবং চিকিৎসক সমাজের নিকট থেকে নানা রকম বিরূপ মন্তব্য ও অভিযোগের সম্মুখীন হচ্ছি। অনেকেই প্রায়ই আমাদেরকে প্রশ্ন করেন তিনি কি আবারও এই বিভাগে ফিরে আসবেন এবং একই ধরনের কার্যক্রম করবেন। আমরা আমাদের অন্যান্য সহকর্মী চিকিৎসক এবং উদ্বিগ্ন রোগীদের এই ধরনের প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারি না।”
এমতাবস্থায় ডা. মো. মাহবুবুর রহমান এই বিভাগে কর্মরত থাকলে তার অনিয়মের পুনরাবৃত্তি এবং রোগীদের প্রতিবাদের আশঙ্কাসহ বর্তমানে বিরাজমান সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হতে পারে। ফলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে ওই চিকিৎসরা চিঠিতে উল্লেখ করেন। তারা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে রোগীদের সুচিকিৎসা ও কাজের পরিবেশ রক্ষার্থে অনতিবিলম্বে তাকে অন্যত্র পদায়ন/ বদলি করার অনুরোধ করেন ওই চিঠিতে।
আরও পড়ুন: ‘মৃত্যুভয় দেখিয়ে আতঙ্ক ছড়ান’ ডা. মাহবুবুর, চালান রিং বাণিজ্য (অডিও ফাঁস)
এ দিকে ডা. মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে গাইবান্ধা সদর থানার একজন অভিযোগকারীকে হুমকির বিষয়ে করা একটি সাধারণ ডায়েরি সাংবাদিকদের হাতে এসেছে। ডাক্তার হয়ে হার্টের রিং (স্টেন্ট) বিক্রি করেন, হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং পরিয়ে তিনটির টাকা নেন, রক্তনালীতে ব্লক না থাকলেও ব্লক আছে বলে ‘আতঙ্কিত’ করে তোলেন— এমন সব অভিযোগের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না হতেই রংপুর মেডিকেল কলেজের কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক মাহাবুবুর রহমান বিভিন্ন প্রভাশালী ব্যাক্তির মাধ্যমে অভিযোগ তুলে নিতে ‘চাপ ও হুমকি’ দিচ্ছেন বলে ২২ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা সদর থানায় জিডি করেছেন ভুক্তভোগী আতোয়ার রহমান।
এদিকে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ডা. মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে রিং বাণিজ্যে ও রোগী মৃত্যুর ছয়টি অভিযোগ ওঠায় এবং তদন্ত চলমান থাকায় কার্ডিওলজি বিভাগে ক্যাথল্যাবে তার ইউনিট বন্ধ করা হয়েছে। ফলে তিনি এখন কার্ডিলজি বিভাগে চিকিৎসা ও রিং পরানোর দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। চিকিৎসা প্রদান ছাড়াই বিভাগে আসা-যাওয়া করছেন তিনি।
উল্লেখ্য, ডা. মাহাবুবের বিরুদ্ধে রিং বিক্রি ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর ছয়টি লিখিত অভিযোগ হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ করা হয়েছে দুনীতি দমন কমিশন, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিএমডিসি, রামেক হাসপাতাল, রংপুর সিভিল সার্জন অফিসে।
গত ২৩ নভেম্বর ২০২৪ গাইবন্ধার বাসিন্দা আতোয়ার রহমান লিখিত অভিযোগ করেন ডা. মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে। প্রতারণার মাধ্যমে ওই হাসপাতালে তার হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং (স্টেন্ট) পরিয়ে তিনটি রিংয়ের টাকা আদায় করে আত্মসাত করেন বলে অভিযোগ করেন আতোয়ার। এরপর কার্ডিলজি বিভাগের তদন্ত কমিটি আতোয়ারের অভিযোগের সত্যতা পায়। কমিটি পরীক্ষা করে দেখে যে আতোয়ারে হার্টে একটি রিং-ই পরানো হয়েছে।
একই হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহিন শাহও গত ৭ ডিসেম্বর লিখিত অভিযোগ করেন ডা. মাহাবুবের বিরুদ্ধে। তার আপন খালুর রিং পরানোর সময় হার্টের রক্তনালীতে ফুটা হয়ে রক্তক্ষরণে ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর মারা যান। তিনি অভিযোগ করেন ডা. মাহাবুুবুর রহমানের অধীনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ‘এনজিওগ্রাম ও রিং পরানোয় ভুল ও অবহেলা হওয়ায় আমার খালু মারা যান।’
মোসা. ফরিদা বেগম ৮ ডিসেম্বর আরেকটি লিখিত অভিযোগে জানান, ২৭ নভেম্বর ডা. মাহাবুবুর রহমান তার স্বামী লাল মিয়ার এনজিওগ্রাম করেন এবং তাকে না জানিয়েই অপারেশন করে হার্টের রক্তনালীতে রিং পরান। চারদিন পর লালমিয়া মারা যান ডা. মাহাবুবুর রহমানের অধীনে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
রংপুরের গঙ্গাচড়ার বাসিন্দা ভুক্তভোগীর ছেলে মোহা. মশিউর রহমান তার অভিযোগপত্রে বলেন যে, পেটে ব্যাথা হলে ১৮ সেপ্টেম্বর ডা. মাহাবুবুর রহমান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনজিওগ্রাম করেন এবং বলেন যে তার মায়ের হার্টের রক্তনালীতে ৭৫ শতাংশ ব্লক আছে। এক লাখ আশি হাজার টাকা দিয়ে রিং (স্টেন্ট) পরাতে হবে। কিন্তু তিনি এনজিওগ্রামের সিডি অন্য দুজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের দেখালে তারা বলেন যে, হাটের রক্তনালীতে কোনো ব্লক নেই।
তবে যার বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগ সেই ডা. মাহাবুবুর রহমান শুরু থেকেই তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। তার দাবি, একটি মহল তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন।
সারাবাংলা/পিটিএম