ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনা
১৩ মার্চ ২০২৫ ১৭:১৬ | আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৫ ১৭:৪৭
দেশব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণের মতো ঘটনা নিয়ে ক্রমশ আলোচনা বাড়ছে। এক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়া ও আইনের কার্যকারীতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। সম্প্রতি নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের মতো ঘটনার প্রতিবাদে রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
কান পাতলেই কোথাও না কোথাও নারী, শিশু নির্যাতনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও সহিংসতার প্রতিবাদ জানিয়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের ভাবনা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতামত ও অনুভূতি তুলে ধরা হলো-
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশাসনের কার্যক্রম লজ্জাজনক:
অহনা পোদ্দার, সরকারি তিতুমীর কলেজ
বিগত কয়েকদিনে দেশে যে পরিমান অনৈতিক, অপকর্ম, খুন, ধর্ষণ হয়েছে তা একেবারেই অকল্পনীয়। এখনো পর্যন্ত কোনো অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি আমরা লক্ষ্য করি নি। প্রশাসন এখানো নিরব। একজন নারী হিসেবে আজ আমি নিরাপদে চলাফেরা করতে পারছি না কারণ প্রশাসন আমাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। প্রশাসন ধর্ষকের সর্বোচ্চ শান্তি নিশ্চিত করতে পারিনি বলেই আছিয়ার মতো কোমলমতি শিশুরাও আজ হায়েনার ছবলে পড়ে। কিন্তু আর কতো? প্রশাসনের কি টনক নড়বে না? কবে আমরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবো? কবে সঠিক বিচার পাবো? দেশে যে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে তা আমাদের কারোই কাম্য নই। এই অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে দেশকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠ বিচার ব্যবস্থা।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি চাই প্রশাসনের দৃষ্টান্ত এবং কঠোর কার্যক্রম। ধর্ষকের শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে দেওয়া হোক। যাতে পরবর্তীতে কেউ এই ধরনের নিকৃষ্টতম কাজ করতে গিয়ে দুবার ভাবে। একজন নারী হিসেবে আমি স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে চাই, স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে চাই। আমি চাই দেশের আইনে ধর্ষণ, খুন, অপকর্মের শাস্তি স্বরূপ এমন শাস্তির বিধান করা হোক যাতে পরবর্তীতে এসব আগুনের ফুলকির মতো না ছড়াতে পারে। একটি শান্তিপূর্ণ, উন্নত, অসাম্প্রদায়িক দেশ আমাদের কাম্য।
ধর্ষণের শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে
সাকিবুল হাছান, ঢাকা কলেজ
ধর্ষণ সমাজ জীবনে এক জঘন্যতম পাপাচার। জিনা-ব্যভিচার সমাজের এক বিধ্বংসী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ধর্ষণ মানুষকে পশুতে পরিণত করে। ব্যভিচারের প্রসারের কারণে মানবতা আজ বিপন্ন হয়। খুবই উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে যা দেশে নারীর সামাজিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
আমি মনে করছি, ধর্ষণের দ্রুত বিচার না হওয়ায় প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ঘরে-বাইরে কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়। তাই ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের জন্য যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং তা যেন বারবার না ঘটে সেদিকে নজর রাখতে হবে। এধরনের জঘন্য অপরাধ ঘটে যাওয়ার পর প্রথমেই অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় তুলে যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা। তারপর অপরাধ বন্ধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ইসলাম বিষয়টির স্পর্শকাতরতা স্পষ্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি ধর্ষকের শাস্তি এবং ধর্ষিতার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। ইসলাম বলে, অপরাধী অবিবাহিত হলে তাকে একশ দোররা ও বিবাহিত হলে তাকে মৃত্যু দেয়া হবে। তবে ব্যভিচারের শাস্তি; যা পুরুষ-মহিলা উভয়কেই প্রদান করা হবে। কিন্তু যদি ব্যভিচার হয় বলপ্রয়োগপূর্বক তাহলে সেক্ষেত্রে বলপ্রয়োগকারী শাস্তি পাবে, যার উপর অত্যাচার করা হয়েছে সে নয়। এভাবে ধর্ষণের বিচারকার্য পরিচালনা করলে দেশে এই জঘন্যতম অপরাধের পুনরাবৃত্তি হবে না।
আছিয়ার জন্য ন্যায়বিচার চাই, নৃশংসতার অবসান হোক
তানজিলা আক্তার মাসুমা, ইডেন মহিলা কলেজ
মাগুরার আছিয়ার ঘটনা শুধু একটি শিশু নির্যাতনের ঘটনা নয়, এটি আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের ভয়ংকর চিত্র। মাত্র আট বছরের একটি শিশুর ওপর যে বর্বরতা চালানো হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। একজন নারী হিসেবে, একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি এই ঘটনায় গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করছি। আমরা কি এমন সমাজে বাস করছি, যেখানে শিশুরাও নিরাপদ নয়?
প্রতিদিন কোথাও না কোথাও আমাদের মা-বোন, শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিছুদিন শোরগোল ওঠে, প্রতিবাদ হয়, তারপর সব ভুলে যাওয়া হয়। কিন্তু আছিয়ার ঘটনা ভুলে গেলে চলবে না। আমরা চাই, এই ঘটনার বিচার দ্রুত হোক। অপরাধীরা যেন কোনোভাবেই আইনের ফাঁক দিয়ে বের হতে না পারে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন পাশবিক কাজ করার সাহস না পায়।
আমি রাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ করব নারী ও শিশু নির্যাতনের বিচারে যেন দীর্ঘসূত্রতা না থাকে। আমরা আর কোনো শিশুর কান্না শুনতে চাই না। প্রয়োজনে আমরা আবারও রাস্তায় নামব, আন্দোলন করব, কিন্তু এই ঘটনার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আছিয়ার জন্য আমরা ন্যায়বিচার চাই, এখনই চাই!
বিচারহীনতা বাড়াচ্ছে ধর্ষণ, নিরাপত্তাহীনতায় নারীরা
ইমু তরফদার, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ
একজন শিক্ষার্থী হিসেবে, আমি সারা দেশে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। আমরা এমন একটি সমাজে বাস করছি যেখানে নারীরা প্রতিনিয়ত নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীরা শাস্তির আওতায় আসছে না। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি আমাদের ন্যায়বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা নষ্ট করছে এবং অপরাধীদের আরও উৎসাহিত করছে।
আমরা যখন শুনি যে বছরের পর বছর ধরে মামলা চললেও ভুক্তভোগীরা সুবিচার পাচ্ছেন না, তখন প্রশ্ন জাগে আমাদের আইন ও প্রশাসন আসলে কার জন্য কাজ করছে? যদি অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়া হয়, তবে আমরা কীভাবে একটি নিরাপদ সমাজের স্বপ্ন দেখি?
আমরা চাই, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের দ্রুত ও কার্যকর বিচার হোক। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। শুধু কঠোর আইন প্রণয়ন করলেই হবে না, তার সঠিক প্রয়োগও জরুরি। পাশাপাশি, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন ভুক্তভোগীকে দোষারোপ না করে অপরাধীকে শাস্তির মুখোমুখি করা দরকার।
আমরা শিক্ষার্থীরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবো। বিচারহীনতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো, কারণ আমরা এমন একটি দেশ চাই যেখানে প্রত্যেক নাগরিক নিরাপদ থাকবে এবং সুবিচার পাবে।
বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা, বিচার হচ্ছে কি?
মোছাঃ কাবা-কাকলী, কবি নজরুল সরকারি কলেজ
বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া ও আইনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গাবতলী থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি বাসে দুই নারী যাত্রীকে যৌণ নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী যাত্রীরা নাটোরের বরাইগ্রাম থানায় বিষয়টি জানালে পুলিশ বাসের চালক সুপার ভাইজার ও সহকারীকে আটক করে। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের হয়নি ফলে আটককৃতরা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
এছাড়াও একটি শিশু শহীদ দিবসে ফুল কুড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। বাড়ির সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়ার হাত ধরে বাড়ির মহিলাদের উপর অকথ্য নির্যাতন, ধর্ষণ চলছে প্রায় প্রতি জেলাতেই।
বাংলাদেশের ধর্ষণের সবোর্চ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায় না। মামলা দীর্ঘ সময় চলতে থাকায় ভুক্তভোগী ও তার পরিবার ন্যায় বিচার পেতে হিমসিম খায়। নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুধু কঠোর আইন যথেষ্ট নয়, আইনের প্রয়োগ করতে হবে, সাথে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা ও সঠিক শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ।
নারী নির্যাতন বন্ধে কঠোর বিচার ও নিরাপত্তা চাই
সাদিয়া বিনতে আবু হানিফ – সরকারি বাঙলা কলেজ
দেশে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা বেড়েই চলছে। প্রতিদিন আমরা সংবাদমাধ্যমে ধর্ষণ ও হত্যার খবর শুনি। কিন্তু বিচার কতটুকু হচ্ছে? আমরা কি এই ভয়ের সমাজে বাঁচতে চাই?
আমাদের চলাফেরা, পোশাক, জীবনযাপন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, অথচ অপরাধীদের শাস্তির নিশ্চয়তা নেই। আমরা চাই না আর কোনো মা-বাবা তাদের মেয়ের নিথর দেহ ফেরত পাক। আমরা নিরাপদ সমাজ চাই, যেখানে নারীরা স্বাধীনভাবে চলতে পারবে।
আমরা চাই অপরাধীদের দ্রুত বিচার এবং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত, আমরা চুপ থাকব না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব। আমাদের ভয় দেখিয়ে থামানো যাবে না।
নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা এবং সামাজিক সচেতনতা জরুরি।
সারাবাংলা/এমআর/এসএইচএস